লেখক পথপ্রদর্শক মাননীয় তপন ঘোষ
আজ মার্চের ৩০ তারিখ । আমি এখন বনগাঁ জেলে । ১৪ ই মার্চ সকাল আটটায় আমার বাড়ি থেকে পুলিশ আমাকে নিয়ে আসার পর এই ১৭ দিনে কতগুলাে জায়গায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হল , তার একটা তালিকা দিই । প্রথমে তাে আমার বাড়ির এলাকার কলকাতার মুচিপাড়া থানা । সেদিন দুপুরেই ব্যাঙ্কশাল কোর্ট । সন্ধ্যায় আলিপুর প্রেসিডেন্সি জেল । পরেরদিন বারুইপুর কোর্ট । সন্ধ্যায় আলিপুর সেন্ট্রাল জেল । ১৮ মার্চ কুলতলি থানার পুলিশ আবার আমাকে বারুইপুর কোর্টে টেনে নিয়ে গেল এবং সাতদিনের রিমান্ড চাইল । অর্থাৎ , তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ কাস্টডি । একে বলে পি.সি .। বারুইপুর কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশের আবেদন মঞ্জুর করে আমাকে সাতদিনেরই পি.সি , দিয়ে দিলেন । সুতরাং আমাকে বারুইপুর কোর্ট থেকে সােজা জয়নগর থানায় নিয়ে গিয়ে লক আপে ঢুকিয়ে দেওয়া হল । কিন্তু সাতদিন কাটার আগেই চারদিনেই আলিপুর জজ কোর্টে আমার জামিন হয়ে গেল । জামিন হল মানে ছাড়া পেলাম না । পরদিন ২৩ মার্চ কুলতলি থানার ও.সি. জয়নগর থানা থেকে তার গাড়িতে বাসিয়ে আমাকে আবার বারুইপুর কোর্টে নিয়ে এলেন । কারণ উচ্চতর আদালতে জামিন পেলেও যে কোর্টে কেস থাকে সেই কোর্টে জামিন কনফার্ম করতে হয় । বারুইপুর কোর্টে যথারীতি জামিন কনফার্ম হয়ে গেল । এইবার সেই জামিনের আদেশ নিয়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে যেতে হবে । সন্ধ্যার আগে পেীছালে সেইদিনই ছাড়া পাব । দেরী হলে পরদিন সকালে ।
আমার যে সহকর্মীরা কোর্টের কাজ দেখাশােনা করছেন , তারা আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করে ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছিলেন ওইনি সন্ধ্যাতেই যেন আমি বেরােতে পারি । তাই বারুইপুর কোর্ট থেকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের গেটে এসে যখন পৌঁছলাম , দেখলাম হিন্দু সংহতির অনেক সহকর্মী ও সমর্থক ওখানে এসে হাজির হয়েছেন আমাকে নিয়ে যাবেন বলে । আমিও জেলগেটের ভিতরে অফিসে অপেক্ষা করছি কখন কাগজপত্রের কাজ শেষ হয়ে ছাড়া পাব । তখনই জেলের একজন স্টাফ এসে জানালেন আমি আজ ছাড়া পাচ্ছি না । উঃ ২৪ পরগণার সুদূর গােপালনগর থানার একটা কেসে আমাকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে । কবে কার কেস , কী কেস কিছুই জানি না । সত্যিই একটু ধাক্কা লাগল । দু-তিন ঘণ্টা ধাক্কাটার প্রভাব মনের উপর ছিল । তারপর নয় । তবে ওই মুহূর্তে আর একটু বেশি চিন্তিত হচ্ছিলাম জেলগেটের বাইরে সহকর্মীদের মনের অবস্থার কথা ভেবে । তারা কতটা ভেঙে পড়বে সেকথা ভেবে । ভাবনা চিন্তার কথা পরে বলব । আগে তালিকাটা পুরাে করি । ২৪ , ২৫ তারিখ আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকার পর ২৬ মার্চ সেখান থেকে আমাকে নিয়ে আসা হল সুদূর বনগাঁ মহকুমা আদালতে । সেখানে ৭-৮ জন আইনজীবি দাঁড়ালেন আমার জামিনের জন্য । তাদের সকলের হয়ে অ্যাডভােকেট প্রদীপ চ্যাটার্জী এবং অন্যরা যা সওয়াল করলেন , যে সকল যুক্তি ও তথ্য দিলেন , এবং সরকারী উকিল ( পি.পি. ) এমন মিন্ মিন্ করলেন এবং কোন যুক্তিই দিতে পারলেন না , এবং তিনি আমার জামিনেরও তেমন কোন বিরােধিতা করলেন না , তাতে বিচারকের পক্ষে আমাকে জামিন দেওয়াটা শুধু কঠিন নয় , আমার মনে হল অসম্ভব । বিচারপতি পি.পি. – কে তাঁর বক্তব্য রাখতে বলছেন । পি.পি. – র কোন বক্তব্যই নেই । পুরাে শুনানির সময় মাননীয় বিচারপতির মুখের অবস্থা ( বডি ল্যাঙ্গোয়েজ ) দেখে আমার যা মনে হচ্ছিল তা যদি লিখি তাহলে আদালতে অবমাননার দায়ের আর একটা কেস নির্ঘাত আমার পিছনে ঢুকবে । যাইহােক , বনগাঁ মহকুমা আদালতে আমার জামিন হল না । কোর্টের বাইরে প্রায় একশত সমর্থক তখন স্লোগান দিচ্ছে । কোর্টের পাশেই জেল । ঢুকলাম বনগাঁ সাব-জেলে । এখন অবশ্য জেলের নাম পরিবর্তন হয়ে হয়েছে ‘ সংশােধনাগার । সুতরাং , ১৪ থেকে ২৬ মার্চ অবধি তালিকাটা হল — মুচিপাড়া থানা , ব্যাঙ্কশাল কোর্ট , আলিপুর প্রেসিডেন্সী জেল , বারুইপুর কোর্ট , আলিপুর সেন্ট্রাল জেল , বারুইপুর কোর্ট , জয়নগর থানা লক আপ , বারুইপুর কোর্ট , আলিপুর সেন্ট্রাল জেল , বনগাঁ কোর্ট , বনগাঁ জেল । এবং কোর্ট মানেই কোর্ট লক আপ । আর পরিস্থিতি যেভাবে গড়াচ্ছে , তাতে তালিকাটা যে এখানেই শেষ , তা আর কোনভাবেই বলা যাচ্ছে না ।
অনেকগুলাে কথা বলতে হবে । ঠিক পর পর হয়ত গুছিয়ে বলতে পারবাে না । এই ১৭ দিনে অনেক পুলিশ অফিসার ও আই.বি. , ডি.আই.বি. ইত্যাদি অফিসারদের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হয়েছে । এছাড়া অনেক ওসি , এস , আই , এ.এস.আই. ও কনস্টেবলের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক হয়েছে । এছাড়া আছেন জেলার ( সুপারিন্টেন্ডেন্ট ) ও জেলের অফিসার ও পুলিশরা । এদের সকলের , প্রত্যেকের ব্যবহার আমার সঙ্গে ছিল অত্যন্ত ভাল । যে সকল অফিসাররা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন , তাঁদের অনেকেই , প্রায় সকলেই অত্যন্ত আপশােষের সুরে আমাকে বলেছেন যে নেহাৎ কর্তব্যের খাতিরে তাঁদেরকে এই কাজ করতে হচ্ছে । অর্থাৎ , পুলিশের সার্বিক-সহানুভূতি আমি পেয়েছি । কিন্তু মুচিপাড়া থানার অফিসাররা বাদে আর কোন অফিসার , কোন পুলিশই তাে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে আগে থেকে চিনতেন না । তাহলে তাদের এই ভাল ব্যবহার ও সহানুভূতির পিছনে কারণটা কী ? তাঁদের অনেকের কথায় সেই কারণটা প্রকাশ পেয়েছে । কারণটা আমার প্রতি কোন ব্যক্তিগত সহানুভূতি নয় । আমার কাজ ও উদ্দেশ্যের প্রতি সহানুভূতি ও নীরব সমর্থন । আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসা অনেক অফিসারই স্বীকার করেছেন যে বর্তমান তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার মুসলিম তােষণের চূড়ান্ত করছেন এবং তার ফলে এ রাজ্যের সর্বনাশ হতে আর বেশি দেরি নেই । এই মুসলিম তােষণের বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করছি , তাই আমাদের কাজের প্রতি নীরব সমর্থন । অবশ্য কিছু অতি লােভী , অতি দুর্নীতিপরায়ণ , নােংরা ধরণের পুলিশ অফিসারও আছেন — তাঁদের কাছে এসব কোন চিন্তার বিষয় নয় । অতি ঘৃণিত সমাজবিরােধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার করা ও টাকা রােজগার করা তাদের একমাত্র কাজ । প্রতি রাত্রে থানায় বসে অথবা সমাজবিরােধীদের ডেরায় তাদের সঙ্গে কষা মাংস সহযােগে মদ্যপান করা এদের প্রতি রাতের রুটিন । তারসঙ্গে আর এক ‘ ম’ও আছে ।
ফিরে আসি আমার জেল দর্শন ও কেস বর্ণনে । প্রথম যে কেসে আমি গ্রেপ্তার হলাম তা হল দঃ ২৪ পরগণা জেলার কুলতলি থানার কেস । জালাবেড়িয়াতে ২০ ফেব্রুয়ারি জনতা ও পুলিশ সংঘর্ষ হয়েছিল । ১৮ ফেব্রুয়ারি ক্যানিংয়ে মৌলবী রহুল কুদ্স খুন হওয়ার ঘটনার জেরে ক্যানিংয়ে চারটে হিন্দু গ্রাম তাে মুসলমানরা জ্বালিয়েছিলই , তাছাড়া ১৯-২০ ফেব্রুয়ারি দুদিন ধরেই জয়নগর ও কুলতলি থানা এলাকা উত্তপ্ত ছিল । প্রিয়র মােড় , খােলাখালি , তুলসীঘাটা প্রভৃতি এলাকায় হিন্দুদের উপর অত্যাচার হচ্ছিল । হিন্দুদের দোকানঘর লুট , ভাঙচুর , পথযাত্রীদের আটকে রেখে অত্যাচার করা , পূজা নষ্ট করা , মহিলাদের শ্লীলতাহানি – সবকিছুই অবাধে চলছিল । তারই প্রতিবাদে ১৯ , ২০ ফেব্রুয়ারি দুদিন ধরেই জালাবেড়িয়াতে হিন্দুরা পথ অবরােধ করছিল । কুলতলি থানার পুলিশ বরাবর সেখানে উপস্থিত ছিল । তাদের উপস্থিতিতেই এই অবরােধ চলছিল । ১৯ তারিখ রাত্রি থেকেও ২০ তারিখ সকাল থেকে প্রায় ২০ জন হিন্দুকে খােলাখালিতে আটকে রেখেছিল মুসলিমরা । তাদেরকে মুক্ত / উদ্ধার করা দাবীতে জালাবেড়িয়াতে হিন্দুরা মাওলা গাজী নামে একজন মুসলিমকে আটকে রেখেছিল । সেখানে কুলতলি থানার পুলিশ মােতায়েন ছিল । মাওলা গাজীকে পুলিশের হেফাজতেই রাখা হয়েছিল । অর্থাৎ তাকে মারধাের করা হয়নি , কোন অত্যাচার হয়নি । তার গায়ে হাত দেওয়া হয়নি । পুলিশের বার বার অনুরােধ সত্ত্বেও হিন্দুরা তাকে যেতে দেয়নি । হিন্দুদের দাবী ছিল — খােলাখালিতে মুসলমানদের হাতে আটকেপড়া হিন্দুদেরকে আগে ছাড়তে হবে । তারপর তারা এই মাওলা গাজীকে ছাড়বে । এইসময় বারুইপুর থেকে বিশাল র্যাফ ও পুলিশবাহিনী আসে এবং পুলিশ জোর করে মাওলা গাজীকে তুলে নিয়ে চলে যায় । তখনই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় ও জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ হয় । এই সংঘর্ষে পুলিশেরও বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ।
তারপরেই জালাবেড়িয়ার বিভিন্ন হিন্দুপাড়ায় পাড়ায় ঢুকে শুরু হয় পুলিশ ও র্যাফের চরম অত্যাচার ও বাড়ি বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার । পরে জানা গেল মােট ২৩ জন হিন্দুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে । বারুইপুর কোর্ট থেকে এফআইআর কপি তুলে দেখা গেল যে পুলিশ
মােট ২৭ জনকে অভিযুক্ত করেছে । তারমধ্যে ২৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছে । হিন্দুদের মধ্যে যারা নেতৃত্ব করে তাদের সকলেরই নাম পুলিশ এফ.আই.আর. – এ ঢুকিয়ে দিয়েছে । সেই এফআইআর – এ অভিযুক্তদের মধ্যে আমার কোন নাম ছিল না । থাকার কোন কথাও নয় । আমি তাে তখন ঘটনাস্থল থেকে ৭০ কিমি দূরে আমার বাড়িতে বসে । বেশ কয়েকদিন পর এফ.আই.আর , -এ আরও ১২ টি নাম যুক্ত করা হল । তারমধ্যে ৩৭ নং অভিযুক্ত হিসাবে আমার নাম । স্পষ্টতঃই বােঝা গেল যে রাজনীতির খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে । রাজনৈতিক হস্তক্ষেপেই আমার নাম এফ.আই.আর. – এ ঢােকানাে হল ।
বন্ধুরা পরামর্শ দিলেন আগাম জামিন নিতে ও কয়েকদিন বাড়ি থেকে সরে থাকতে । না বলে দিলাম । পালাবাে না , গ্রেপ্তার হব । সেজন্য ১৪ মার্চ সকালে মুচিপাড়া থানার পুলিশ অফিসার যখন আমার বাড়িতে এসে খুবই ভদ্রভাবে বললেন যে থানায় যেতে হবে , কুলতলি থানার কেসের ওয়ারেন্ট আছে , তখন মােটেই অবাক হইনি । তাই দাড়ি কাটা ও স্নান সেরে পুলিশের সঙ্গে মুচিপাড়া থানা চলে এলাম । পুলিশ আমাকে লক আপে ঢোকায়নি । দুবার চা খাইয়ে কাগজপত্র তৈরি করে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে নিয়ে গেল । তারমধ্যে অবশ্য সংহতি কর্মী ও উকিলরা এসে গিয়েছেন ।
২৩ মার্চ কুলতলি থানার কেসটা থেকে জামিন পেয়ে আলিপুর জেল গেটেই যখন গােপালনগর থানার কেস দিয়ে আবার গ্রেপ্তার করা হল , একটু ধাক্কা খেয়েছিলাম । ঘণ্টা দুয়েক তার প্রভাব মনের উপর ছিল । কয়েকটা কথা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে লাগল । প্রথমতঃ , আমি ওদের টার্গেট হয়ে গিয়েছি । আমার গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে । দ্বিতীয়তঃ , পুলিশ প্রশাসনের যে স্তর থেকে আমার উপর মনিটরিং করা হচ্ছে এবং আইন ও প্রশাসনের চান অপব্যবহার করে আমাকে ফাঁসানাে হচ্ছে , সেটা জেলা প্রশাসনেরও ঊর্ধ্বে । রাজনীতির কর্তারা প্রশাসনকে দিয়ে এই কাজ করাচ্ছেন । সি.পি.এম. আমলে যে মেরুদণ্ডহীন প্রশাসন তৈরি করা হয়েছিল এবং পার্টির কাজে পুলিশ লাগানাের প্রথা শুরু হয়েছিল — সেই অভিশাপ থেকে পশ্চিমবঙ্গ এখনও মুক্ত হয়নি । কোনােদিন হবে কিনা বলা কঠিন ।
গােপালনগর থানার কেসটার বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না । ২৬ মার্চ বনগাঁ কোর্টে আমার জামিনের শুনানিতে উকিলদের বক্তব্য থেকে জানলাম যে গত ২৭ অক্টোবর , অর্থাৎ ঠিক পাঁচ মাস আগে , গােপালনগর থানার মাগুরখালি গ্রামে বকরিদের সময় গরু কাটা নিয়ে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয় । সেই ঘটনায় পুলিশ একটি এফ.আই.আর. করে । সেই এফ.আই.আর. – এ পাঁচজন হিন্দুর নাম আছে এবং আরও ১৫০-২০০ জন গ্রামবাসীর কথা উল্লেখ আছে যারা ওই ঘটনায় জড়িত ছিল । ওই ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি । পুলিশের একটা গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে । কিন্তু কোন সিজার লিস্ট বা কোন ‘এক্সিবিট ’ নেই । পুলিশ এফ.আই.আর , করেছে , কিন্তু কোন গ্রেপ্তার করেনি । যে পাঁচজনের নাম অভিযুক্ত হিসাবে আছে অথবা উল্লেখিত ১৫০-২০০ জন গ্রামবাসী — কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি এবং কেসটারও কোন অগ্রগতি হয়নি । অর্থাৎ পুলিশ কেসটা নিয়ে কিছুই করেনি । তারপর হঠাৎ ২৩ মার্চ গােপালনগর থানার ওসি , বনগাঁ কোর্টে একটি আবেদন করেন আমাকে গ্রেপ্তার করতে ওয়ারেন্ট জারির জন্য । আবেদনে ও.সি. বলেন যে ওই কেসের তদন্ত করে তিনি জেনেছেন যে ২৭ অক্টোবর মাগুরখালির গণ্ডগােলে নাকি আমার ইন্ধন বা প্ররােচনা ছিল । আমার উকিল আদালতে বললেন যে এফ.আই.আর. – এ অভিযুক্তদের যাদের নাম আছে এবং যাদের নাম নেই ( ১৫০-২০০ গ্রামবাসী ) তাদের কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ এবং কোন জিজ্ঞাসাবাদও করেনি , তাহলে তদন্তটা কিভাবে করল পুলিশে ? আমাদের উকিল পুলিশকে ব্যঙ্গ করে বললেন যে অন্য কমিউনিটির লােকেরাই কি তদন্ত করে পুলিশকে তপন ঘােযেৱনামটা জানিয়ে দিয়েছে ? সব শুনেও বিচারকের মুখ পাথরের মত । যাইহােক , আমার বাড়ি থেকে ১০০ কি.মি. দূরে অবস্থিত যে মাগুরখালি গ্রামের নামও আমি কখনও শুনিনি , যাওয়া তাে দূরের কথা , সেই গ্রামের পাঁচমাস আগের একটি কেসে আমার নাম ঢুকিয়ে দিয়ে আমাকে গ্রেপ্তার করা হল । ঢুকে গেলাম বনগাঁ জেলে । পরে গােপালনগর থানার ওসিকে সংগঠনের পক্ষ থেকে ফোন করা হলে তিনি জানালেন যে তিনি অসহায় । তাঁর উর্দ্ধতন অফিসারের নির্দেশে তিনি এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন ।
আগামী ২ এপ্রিল অর্থাৎ বনগাঁ জেলে আসার সাতদিনের মাথায় আমার জামিন পাওয়ার কথা । কিন্তু শাসকদলের যা মনােভাব দেখা যাচ্ছে , তাতে যে কোন কিছু হতে পারে । অর্থাৎ একের পর এক মিথ্যা কেসে আমাকে জড়িয়ে দিয়ে জেলেই ঢুকিয়ে রাখা । তারজন্য আমাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতেই হবে । হিন্দু সংহতি শুরুর সময় থেকে দুটি মন্ত্র বা সূত্র হিন্দু যুবকদের মনে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমি । “ মাটি বাপের নয় , মাটি দাপের ‘ , এবং এ জগতে কোনকিছু উপযুক্ত মূল্য না দিয়ে পাওয়া যায় না । ‘ এবছর ১৪ ফেব্রুয়ারী আমাদের পঞ্চম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে বিশাল জনসভায় মঞ্চের মাথায় লেখা ছিল— “ এই বাংলায় হিন্দুর অস্তিত্ব ও সম্মান রক্ষায় চাই আরও বলিদান । আমরা প্রস্তুত । ‘ হিন্দু যুবকদেরকে আহ্বান জানিয়েছি মূল্য দিতে । এই মূল্য দেওয়া আমাকেই তাে শুরু করতে হবে । আর , ‘ বলিদান দিতে আমরা প্রস্তুত ‘ । এই ‘ আমরা’র প্রথম ব্যক্তিটা কে হবে ?
সেদিন যখন আলিপুর জেল গেটে সুদুর গােপালনগর থানার কেসে আমাকে জড়িয়ে দেওয়ার কথা জানতে পারলাম , তখন আমার পড়ল যে ১৪ ফেব্রুয়ারী সুবােধ মল্লিক স্কোয়ারে বক্তৃতায় আমি গুরু গােবিন্দ সিং – এর মত আত্মত্যাগ ও বলিদানের কথা বলেছিলাম । এখন মনে হচ্ছে উদাহরণটা খুব সঠিক হয়নি । গুরু গােবিন্দের আগে গুরু তেগবাহাদুর চাই । ঔরঙ্গজেবের রাজত্বে দিল্লি লালকেল্লার সামনে চাঁদনি চকে প্রকাশে জনসমক্ষে ঔরঙ্গজেবের ঘাতকরা গুরু তেগবাহাদুরকে হত্যা করল তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় । তেগবাহাদুরের বলিদান হবে , তবে তা গুরু গােবিন্দ তৈরি হবেন । তার আগে কী করে হবে ? তাই আমি যখন হিন্দু যুবকদের আহ্বান জানিয়েছিলাম গুরুগােবিন্দ সিংয়ের মত হওয়ার জন্য , তখন আমার মনে আসেনি তেগবাহাদুর কে হবে ? ২৩ মার্চ আলিপুর জেল গেটে আমার মনে হল যে আমাকেই শিখদের নবম গুরু তেগবাহাদুরের ভূমিকা পালন করতে হবে । কারণ ঔরঙ্গজেবের শাসনই তাে চলছে এই বাংলায় – স্বনামে নয় , বেনামে ।
এইবার একটু জেলের বর্ণনা দিই । সেই ১৯৭৬ সালে আলিপুর প্রেসিডেন্সী জেলে দুমাস ছিলাম । তখন আমি সংঘের স্বয়ংসেবক হিসাবে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধে ও আর এস এস কে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে আরও অনেকের সঙ্গে সত্যাগ্রহ করে জেলে গিয়েছিলাম । সারা ভারতব্যাপী সেই সত্যাগ্রহ হয়েছিল লােকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে লােক সংঘর্ষসমিতির ব্যানারে । ১১ জনের দল নিয়ে কলকাতার বিবিডি বাগে রাইটার্স বিল্ডিং – এর সামনে আমরা আইন অমান্য করেছিলাম ৯ জানুয়ারী । তৎকালীন ডি , আই , আর , আইনে অর্থাৎ ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া রুলে আমাদেরকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানাে হয়েছিল । দুমাস ছিলাম । তাই প্রেসিডেন্সী জেলের ভিতরটা ভালভাবেই দেখা ছিল । এবার গিয়ে দেখলাম যে ওই জেলের ভিতরের অবস্থা ও ব্যবস্থা আগের থেকেও খারাপ হয়েছে । এবং দুর্নীতির আখড়াতে পরিণত হয়েছে । অবশ্য শ্রী অরবিন্দের সেল ও সুভাষচন্দ্রের সেল একইরকমভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে ।
তারপর গেলাম আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে । এই জেলও আমার কাছে নতুন নয় । গতবছর সরকার । ও পুলিশের বহু বাধা পার করে ১৪ ফেব্রুয়ারী চতুর্থ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করার পরেই রাত্রি দশটায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয় বাড়ি থেকে । ওই অনুষ্ঠানের প্রচার পত্র লেখার অভিযােগে । যাদবপুর থানায় কেস দিয়েছিল । তখনও চারদিন ছিলাম এই সেন্ট্রাল জেলে । তাই এই জেলের পরিবেশ ও পরিস্থিতি মােটামুটি জানা ছিল । এবার দেখলাম প্রায় একইরকম আছে । ব্যবস্থা মােটামুটি ভাল । তবে ব্যবস্থার বারাে আনাই চালান সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীরা । আরও নির্দিষ্ট করে বললে — যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীরা । তাঁরা যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে সমস্ত কাজ সম্পন্ন করেন ।
এইবার জেলে আমার সুবিধা অসুবিধার কথা । জেল , বিভিন্ন কোর্ট লকআপ ও থানা লক আপে বহু রকমের অসুবিধা তাে আছেই । খাওয়া দাওয়ার বর্ণনা করে আর কি হবে ! তবে এটা না বললে অন্যায় হবে যে জেলে খাবারের কোয়ালিটি যাই হােক না কেন দিনে দুবার করে ভাত , ডাল ও তরকারির পরিমাণ একজন মানুষের পক্ষে যথেষ্ট । মােটামুটি আমার খাওয়ার পরিমাণের চারগুণ বেশি । রুটি বড় শক্ত । এবং রাত্রের রুটি ও ডাল তরকারি মাঝে মাঝে ট্ক হয়ে যায় কারণ সকাল দশটা থেকে রান্না হয় বলে । খাবার ছাড়া বড় অসুবিধা হল জল , বাথরুম ও মশা । স্নান , পায়খানা , সাবান , দাড়িকাটা ইত্যাদি নিয়ে অনেক অসুবিধা হয় । থানা লক আপে তাে পায়খানার বালতির জলেই স্নান করা । এক বালতি জল প্রাপ্য । বাড়ির সঙ্গে তুলনা করলে অনেক কিছুতেই গা ঘিন ঘিন করে । কিন্তু আমার অসুবিধাও বেশি হয়নি , গা ঘিন ঘিনও করেনি । কারণ , মনটা তাে প্রস্তুত । তাছাড়া বােধহয় শরীর ও মনকে বেশ কিছুটা আলাদা করে নিতে পেরেছি । ক্ষিদে বা শরীরের অন্য কষ্ট মনকে বেশি কষ্ট দিতে পারছে না ।
তার থেকেও বড় আর একটা বিষয় আছে । মনে ভাবি এই কষ্টটা কতটা বেশি ? যখন জেলের বাইরে থাকি , হিন্দুদের উপর একের পর এক অত্যাচারের খবর আমার কাছে আসতে থাকে , তখন যে মানসিক কষ্ট পাই কোন প্রতিকার করতে না পারার জন্য , থানা লক আপ ও জেল ফাইলের কষ্ট আমার কাছে তার থেকে অনেক কম মনে হয় । নওদা থানার ঝাউবানা গ্রামের যে বৃদ্ধটিকে কাটারি দিয়ে এলােপাথাড়ি কোপানাে হয়েছিল , সেই দাগগুলাে এবং সেই বৃদ্ধের মুখটা এখনও আমার চোখে ভাসছে । হাওড়া জেলার নােরিট গ্রামের যে গৃহবধূটির কানের দুল কান ছিঁড়ে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল , সেই মুখ ও সেই ছেঁড়া কান এখনও আমার স্মৃতিতে দগদগে । ওই গ্রামেরই আর এক বৃদ্ধাকে বাঁশ দিয়ে প্রচণ্ড মেরে তারপর মাটিতে ফেলে চুল ধরে টানতে টানতে বহুদূর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল মুসলিম দুষ্কৃতিরা , সেই বর্ণনা যখন শুনেছিলাম তা তাে কোনদিনই ভুলতে পারবাে না । পাঁচলায় তৃণমূল নেতা প্রশান্ত বেজের বাড়ি কিভাবে আগুন দেওয়া হয়েছিল , তার মেয়ের বিয়ের ঠিক আগে সমস্ত জিনিসপত্র লুট করেছিল , বাড়ির মেয়েরা পালিয়ে গিয়ে সন্ত্রম রক্ষা করেছিল , এবং পাঁচলা বাজারের ৫৪ টি হিন্দু দোকান লুট হয়েছিল , বাজারের পাশেই থানা , কিন্তু একজন হিন্দুও ভয়ে একটা এফ.আই.আর. – ও করেনি — ভুলবাে কি করে ? ২০১০ সালে দেগঙ্গার ৮ টি গ্রামে তিনদিন ধরে শত শত হিন্দু বাড়িতে লুট ও আগুন , ২০১২ সালে কুলতলির তারানগর-রূপনগর গ্রামে ৫০ – এর বেশি হিন্দু বাড়িতে লুট ও আগুন , ২০১৩ সালে ক্যানিংয়ের নলিয়াখালি সহ চারটি গ্রামে ২০০ হিন্দু বাড়ি লুট ও আগুন এবং সব ঘটনাগুলিতেই ডিজেল ও কেরােসিন ঢেলে ধানের গােলাগুলি পুড়িয়ে দেওয়া , বাসন্তী থানার গ্রামে শিবাণী সাঁপুইয়ের যৌনাঙ্গে লাঠি ঢুকিয়ে দেওয়া , তারপর আর একটা ঘটনায় ওই শিবাণীকেই বাসন্তী থানারই খালেক নামে এক পুলিশ অফিসারের প্রচণ্ড মারধাের , সন্দেশখালি থানার পুরানাে সরবেড়িয়া গ্রামে চ্যালা কাঠ দিয়ে কাজল বৌদির মাথা ফাটিয়ে দেওয়া , মন্দিরবাজারের রঘুনাথপুরের ধর্ষণের ঘটনা এবং পুলিশের ঘৃণ্য আচরণ , তালিকা সীমাহীন । স্বরূপনগরের খাবরাপােতা , বজবজের পুরকাইত পাড়ার অত্যাচারিতা মেয়ে ও বৌদের মুখ আমি ভুলতে পারি না । যখন এইসব ঘটনার খবর আসে আমার কাছে , সঙ্গে থাকে প্রশাসনের নির্লজ্জ পক্ষপাতমূলক ও মুসলিম তােষণকারী আচরণের খবর , তখন কোন প্রতিকারের উপায় না পেয়ে অসহায় যন্ত্রণায় ছটফট করি , কষ্ট পাই , বর্তমানে জেল ও থানা – কোর্ট লক আপের শারীরিক কষ্টগুলােকে তার তুলনায় অনেক কম বলে মনে হয় ।
http://www.facebook.com/suparhumanTAPANGHOSH/
এছাড়াও মনে হয় , দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা ২৭ বছর জেলে কাটিয়েছেন বর্ণভেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে । তারপ সেদেশে আইন প্রণয়ন করে বর্ণভেদ দূর করা হয়েছে । মায়ানমারের নেত্রী আওয়াং সু চি ১৭ বছর বন্দী ছিলেন গণতন্ত্রের দাবীতে । তারপর সেদেশে গণতন্ত্রের রাস্তা পরিষ্কার হয়েছে । আমাদেরই দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে কত কারাবাস , কত কালাপানি , কত প্রাণের মূল্য দিতে হয়েছে । কিন্তু স্বাধীন ভারতে বৃহত্তম হিন্দু আন্দোলন – অযােধ্যায় রামমন্দির পুনর্নির্মাণ আন্দোলনে একজনও হিন্দু নেতা একদিনের জন্যও জেল খাটেন নি । তাই রামমন্দির নির্মাণ আজ শত যােজন দূর । নেলসন ম্যান্ডেলা , সু চি – রা তাঁদের আদর্শের জন্য যে মূল্য দিয়েছেন — আমাদের দেশের নামকরা হিন্দু নেতারা তাঁদের আদর্শের জন্য সে মূল্য দিতে প্রস্তুত নন । আমি নিশ্চয় সেরকম হিন্দু নেতা হতে চাই না । আমি জেলের বাইরে থেকে হিন্দুদের উপর অত্যাচার অপমান অন্যায়ের প্রতিকারে যতজন যুবককে অনুপ্রাণিত করতে পারব , আমি জেলের ভিতরে থাকলে হয়ত তার থেকে বেশি যুবক অনুপ্রাণিত হতে পারে । ছােট্ট সুভাষ যখন কটকে প্রাথমিক স্কুলে পড়তেন , তখনই সে তাঁর পড়ার ঘরে ক্ষুদিরামের ছবি লাগিয়েছিল । ওই ছবি সুভাষের বৃটিশভক্ত পিতা ও নামকরা উকিল জানকীনাথ বসু খুলে সরিয়ে দিয়েছিলেন । কিন্তু পরবর্তী ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে সুভাষ তাঁর বাবার আদর্শকে নেয়নি , ক্ষুদিরামের আদর্শকেই নিয়েছেন । আজ একথা স্পষ্ট করে বলার সময় এসেছে যে বাংলা তথা ভারতের হিন্দু স্বাধীনতার জন্য হিন্দু ক্ষুদিরাম , হিন্দু ম্যান্ডেলা ও হিন্দু সু চি – র দরকার আছে । ত্যাগ ও বলিদান বিনা শুধু প্রেরণার বাণী কোন কাজে লাগে না – সাধ্বী ঋতম্ভৱা ও উমা ভারতীদের আশি ও নব্বই দশকের সেই আগুন ঝরানাে ভাষণগুলাের কি আজ সেই পরিণতিই হয়নি ? কোথায় রামমন্দির , কোথায় হিন্দুরাষ্ট্র , কোথায় ইউনিফর্ম সিভিল কোড , কোথায় কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি ? সাধ্বী ঋতম্ভরার উত্তরপ্রদেশে আজ কুম্ভমেলা আয়ােজন কমিটির চেয়ারম্যান ভারতমাতাকে ডাইনি বলা চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক মন্ত্রী আজম খান । এমনকি মেলা আয়ােজনের স্থানীয় কমিটির কর্তাও একজন মুসলমান । তাই এই হিন্দুনেতারা মুখে রামভক্ত হলে কি হবে , জটায়ু হতে কেউ প্রস্তুত নন । কিন্তু জটায়ু ছাড়া তাে সীতা উদ্ধার হবে না । অভিমন্যু ও ঘটোৎকচ বধ ছাড়া তাে কুরুক্ষেত্র বিজয় ও ধর্মস্থাপন হবে না । এই হিন্দু নেতাদের আহ্বানে ১৯৯০ সালে আমরা যখন সারা দেশে জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে আকাশ কাঁপিয়ে তুলছিলাম , মনে হচ্ছিল হিন্দু রাষ্ট্র হতে বােধহয় আর বেশি দেরী নেই , ঠিক তখনই , সেই ১৯৯০ সালের জুন মাসে কাশ্মীর থেকে সমস্ত হিন্দুকে বিতারণ করল উগ্রপন্থীরা । সেদিনের তিন লক্ষ বর্তমানে ৬ লক্ষ কাশ্মীরি হিন্দু আজও রিফিউজি । ত্যাগ ও বলিদান বিহীন ভাষণাঞ্জলির এই পরিণাম ।
এইসব সদ্য অতীতের ইতিহাস থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতেই হবে । না হলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের পরিণতি বাংলাদেশ বা কাশ্মীরের মত হতে আর বেশি দেরি নেই ।
বনগাঁ জেলে বসে লিখছি । কিন্তু এই জেলের কথা কিছুই লেখা হল না । সংক্ষেপে লিখি — এই জেলের ৩ নং ওয়ার্ডকে ভালােবেসে ফেলেছি । ছােট্ট জেল । আলিপুরের মত ব্যবস্থা হলে এখানে ২০০ কয়েদী থাকতে পারে । আছে ৪৫০ – এর বেশি । প্রত্যেককে গায়ে গা ঠেকিয়ে শুতে হয় ।। দিনেরবেলায় প্রাঙ্গণে চলতে গেলে গায়ে ধাক্কা । লাগে । পানীয় জলের একটিমাত্র টিউবকল । ৬ টি ওয়ার্ডের ভিতরে একটি করে পায়খানা । বাইরে ১০ টি । জলের অভাবে প্রায়ই নােংরা হয়ে থাকে । কিন্তু এত ভিড়েও অদ্ভুত রকমের সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ । শৃঙ্খলা ভাঙার প্রবণতা খুবই কম । অল্প কয়েকজন জেল পুলিশের খাকি পােশাকটুকুই যথেষ্ট এখানে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে । জেল প্রাঙ্গণে চার – পাঁচটা উঁচু লম্বা লম্বা গাছ । সকালের হাওয়াটা লাগে খুব সুন্দর । এত ভিড় না থাকলে ঠিক যেন তপােবনের মত পরিবেশ ।
এই জেলে বন্দীদের মধ্যে ৭০ শতাংশই বাংলাদেশী যারা বিনা পাসপাের্টে ভারতে ঢুকে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে । এদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ হিন্দু , ৫০ শতাংশ মুসলমান । এরা প্রায় কেউই ক্রিমিনাল নয় । বাংলাদেশী মুসলিমরা প্রায় সকলেই কাজের সন্ধানে ভারতে ঢুকেছে । হিন্দুদের মধ্যে অল্প কিছু কাজের সন্ধানে , বাকিরা আত্মীয়বাড়ি , চিকিৎসা , বেড়ানাে ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ভারতে ঢুকেছে । সরকারি অফিসারদের কাছে জানা গেল — যে পরিমাণ বাংলাদেশী ধরা পড়ছে তার কয়েকশ গুণ বেশি ঢুকে পড়ছে । অর্থাৎ ক্রিমিনালগুলাে ধরা পড়ছে না । নিরীহ গােবেচারাগুলাে ধরা পড়ে যাচ্ছে । তাদেরই ভিড় এই বনগাঁ জেলে । আমাকে ৩ নং ওয়ার্ডে দেওয়া হয়েছে । যদিও দুই দাড়িওয়ালার মাঝে গা ঠেকিয়ে আমাকে শুতে হচ্ছে , কিন্তু বেশ কয়েকজন বাংলাদেশের হিন্দু কিশােরের সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গিয়েছে । নড়াইলের রাজু , বাগেরহাটের অরূপ , প্রণয় , যশােরের প্রভাস , শরীয়ৎপুরের উজ্জ্বল — এরা সবাই বিভিন্ন কাজে আমাকে সাহায্য করছে । প্রথমদিন ঢুকেই , আমার মনে হয়েছিল — এটা জেলখানা , না কোন সংস্থার ক্যাম্প চলছে ! সত্যিই এত অসুবিধার মধ্যেও জেলের এই পরিবেশ আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল । এছাড়া বনগাঁর সংহতি কর্মীরা আমার সুযােগসুবিধার জন্য সদা তৎপর । তাই অসুবিধা তেমন কিছু হচ্ছে না । সকালে ৬ টায় গুণতি করে ওয়ার্ড থেকে ছাড়ার পর লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত জন-গণ-মন গাওয়া হয় । তারপর তিনবার করে তিনটি ধ্বনি দেওয়া হয় — ভারতমাতা কী জয় , জয়হিন্দ ও বন্দেমাতরম । এসবে সবাই গলা মেলায় না । কিন্তু সকলেই লাইনে এসে দাঁড়াতে দেরী করে না । সব ঘরে টিভি আছে । ৩ নং ওয়ার্ডে প্রতিদিন দুবেলা পূজা হয় ও সকলকে প্রসাদ দেওয়া হয় । দোতলার ওয়ার্ডে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সংকীর্তন হয় । সব মিলে বনগাঁ জেলের পরিবেশ আমার ভাল লেগেছে ।
শেষপর্যন্ত ২ রা এপ্রিল কলকাতা থেকে শান্তুনু সিংহ , সুদীপ্তা মজুমদার , ব্ৰজেন রায় , সােমরাজ গাঙ্গুলী এবং কয়েকজন অ্যাডভােকেট বনগাঁ কোর্টে গিয়ে আমার জামিন করান । ওইদিন বিকালে আমি বনগাঁ জেল থেকে বের হই । বনগাঁর প্রায় দুশাে সংহতি কর্মী সেদিন আবির ছড়িয়ে মিছিল করে আমাকে বনগাঁ জেল গেট থেকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে আসে ।
সংকলন শুভঙ্কর নাগ এপ্রিল ২০১৩
সংগৃহীত স্বদেশ সংহতি সংবাদ
