লেখক পথপ্রদর্শক মাননীয় তপন ঘোষ
হিন্দু সংহতির সাত বছর পূর্ণ হয়ে আট বছরে পড়ল । সফলভাবে উদযাপিত হল বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান কলকাতার ধর্মতলায় । জনসমাগম গতবারের থেকেও বেশি । রাণী রাসমণি রােডের তিনটি রাস্তাই ভরে গিয়েছিল । গতবার পর্যন্ত এই সমাগমকে বলেছি হিন্দু যুব সমাবেশ । কিন্তু এবার বলতে হচ্ছে জনসমাবেশ । বলতে যে খুব খুশি হচ্ছি তা নয় । গতবার পর্যন্ত আমাদের সমাবেশের ৯৫ শতাংশই থাকত শুধু যুবরা । এবার সেটা হয়েছে ৯০ শতাংশ । আর সাধারণ ১০ শতাংশ । এই ১০ শতাংশকে তাে বাদ দেওয়া যায় না । তাই শুধু যুব সমাবেশ না বলে বলছি জনসমাবেশ । এর দুটো দিকই আছে । ভাল দিকটা হল — হিন্দু সংহতির আহ্বান ও কাজ সমাজের সাধারণ মানুষও আজ গ্রহণ করতে লেগেছে । অর্থাৎ যুব অংশগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সার্বিক সমাজের স্বীকৃতি । এই সমাবেশের প্রস্তুতিপর্বেও এবার লক্ষ্য করেছি , যেন অনেকটা সহজ ও স্বাভাবিক । অনেকেই যেন অপেক্ষা করেই ছিল এই দিনটার জন্য — এদিন কলকাতায় আসতে হবে । কলকাতায় আসা , মিটিং-এ ভিড় করা — এটা বড় কথা নয় । বড় কথা হল এই যােগদানের মাধ্যমে মুসলিম অত্যাচারের বিরুদ্ধে হিন্দু প্রতিরােধের আহ্বানকে স্বীকার করে নেওয়া । ঠিক এই জন্যই হিন্দু সংহতির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ।
হিন্দু সংহতির নামে গােটা রাজ্যব্যাপী একটা শক্তিশালী হিন্দু প্রতিরােধ গড়ে উঠুক , এটাই প্রত্যাশা । হিন্দু সংহতি নামে একটা শক্তিশালী সংগঠন গড়ে উঠুক , এটা কাম্য নয় । হিন্দু সংহতি যদি একটা পাকাপােক্ত সংগঠনের রূপ নেয় তাহলে বােধ হয় এর উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে । হিন্দু সংহতির ভূমিকা হওয়া উচিত অনেকটা পরাধীন ভারতের ‘ বন্দে মাতরম্ ‘ – এর মত । বন্দে মাতরম্ বলতে হলে কোন দলের সদস্য হতে হত না , কোন দল করতে হত না । শুধু দেশকে ভালােবাসা আর ইংরেজ বিরােধী মানসিকতাই যথেষ্ট ছিল । আর দরকার ছিল সাহস । যার অতটা সাহস নেই সেও একান্তে গােপনে বলত বন্দে মাতরম্ । যার সাহস আছে সে জনসমক্ষে চিৎকার করে বলতে বন্দে মাতরম্ । এই নিরীহ দুটি শব্দ ইংরেজের কাছে এতই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল যে , বৃটিশ সরকার আইন করে বন্দে মাতরম উচ্চারণ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল । স্কুল কলেজে বলা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল । বন্দে মাতরম্ বলে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার নাগপুরে স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন আর আমাদের বাংলার ছেলে সুশীল সেন আলিপুর আদালতে ১৫ ঘা বেত খেয়েছিলেন । এই বেত খাওয়ার পরেই বাংলার চারণ কবি গান লিখেছিলেন — ‘ বেত মেরে কি মা ভুলাবি , আমরা কি মা’র সেই ছেলে ?
সুজলা সুফলা অখণ্ড বাংলার দুই তৃতীয়াংশ থেকে বাঙালি হিন্দু অত্যাচারিত , অপমানিত ও বিতাড়িত । বাকি এই এক তৃতীয়াংশ পশ্চিমবঙ্গেও বাঙালি হিন্দুর স্বাধীনতা আজ বিপন্ন । তার অধিকার নেই , তার নিরাপত্তা নেই , তার মা – বােনের সম্ভ্রম রক্ষার কোন গ্যারান্টি নেই , তার জমি ও সম্পত্তি রক্ষার কোন গ্যারান্টি নেই , তার মঠ-মন্দির-ধর্মীয় অনুষ্ঠান , দেবােত্তর সম্পত্তি ও শ্মশানের জমি রক্ষারও কোন গ্যারান্টি নেই । এককথায় , শহরের হিন্দু বৈষম্যের শিকার আর গ্রামের হিন্দুর বৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গে নির্যাতনের শিকার । যাদের হাতে এই নির্যাতন তারা বাংলার হিন্দুদের উপর পাঁচশ বছর রাজত্ব করেছে , বলপ্রয়ােগে লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করেছে , এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে বাঙালি হিন্দুর হাত থেকে দুই তৃতীয়াংশ জমি কেড়ে নিয়ে বিতাড়িত করেছে । তারাই আবার এই বাংলায় অত্যাচারীর ভূমিকায় । অবশ্য দোষ তাদের একার নয় । তাদের অনুচর হয়ে কাজ করা হিন্দু এবং ভােটলােভী রাজনৈতিক দলগুলি তাদের এই অত্যাচারে পরিপূর্ণ মদত দিচ্ছে । একদিকে প্রগতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ভণ্ডামি করা বামপন্থীরা , আর একদিকে ক্ষমতালােভী রাজনৈতিক দলগুলির জোটবদ্ধ মুসলিম ভােটের লােভ এবং মুসলমানদের অপরাধপ্রবণ শক্তির কাছে নতজানু প্রশাসন — এই তিনের যাঁতাকলে পড়ে গ্রামবাংলার হিন্দুর ধন-মান তাে বটেই এমনকি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে । বহু বহু জায়গাতে হিন্দু সংখ্যালঘু হয়েছে । এমন কি বহু স্থান হিন্দুশূন্য হয়ে গেছে । পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জেলা ও শতাধিক ব্লকে আজ হিন্দু সংখ্যালঘু । অর্থাৎ পুনরায় আর এক পাকিস্তানের পটভূমি তৈরি হচ্ছে । যে অন্ধ সেই শুধু দেখতে পায় না এই পাকিস্তানের পূর্বাভাস , যে বধির একমাত্র সেই শুনতে পায় না এই পাকিস্তানের পদধ্বনি । আর হিন্দুবিদ্বেষী , ভণ্ড প্রগতিশীল সেকুরা ও বামপন্থীরা এটা স্বীকার করে না ।
এই সপ্তরথীবেষ্টিত বাংলার হিন্দুকে কে বাঁচাবে ? জানি না কে বাঁচাতে পারে । তবে কোন রাজনৈতিক দল অথবা কোন সংগঠনের একক ক্ষমতায় তা সম্ভব হবে না , সে দল বা সংগঠন যতই বড় বা শক্তিশালী হােক না কেন । এর জন্য গােটা পশ্চিমবাংলার সমস্ত হিন্দুকে এগিয়ে আসতে হবে , এই কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে । এরজন্য প্রয়ােজন গােটা রাজ্যব্যাপী একটা বিশাল আন্দোলন । দলীয় আন্দোলন নয় , রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের আন্দোলন নয় , অস্তিত্ব ও আত্মরক্ষার আন্দোলন । এর পৃষ্ঠভূমিতে ‘৪৭ -এর দেশভাগ , হিন্দু নির্যাতন ও হিন্দু বিতাড়ন তাে আছেই । এর ভিত্তিতে থাকবে একটা ভাবনার প্রবাহ । স্বাভিমানের সঙ্গে বাঁচার একটা আকুতি । ভবিষ্যত প্রজন্মের নিরাপত্তা রক্ষার একটা তীব্র কামনা । এই আকুতি এই কামনাই পরাধীন ভারতের বন্দে মাতরমের মত কোন একটা প্রতীককে অবলম্বন করে বহুরূপে প্রকাশ পাবে জনগণের মধ্য থেকে । আজ এই পশ্চিবঙ্গকে বাঁচাতে , বাংলার হিন্দুকে বাঁচাতে হিন্দু সংহতি সেই সর্বজনস্পর্শী আন্দোলনরূপে আত্মপ্রকাশ করতে চায় । বন্দে মাতরম্ ধ্বনি নিয়ে যেমন করে সেদিন বৃটিশ বিরােধী আন্দোলন সর্বস্পর্শী হয়েছিল , ঠিক তেমনি হিন্দু সংহতির নাম নিয়ে হিন্দু রক্ষার তীব্র ইচ্ছা ও মুসলিম অত্যাচারের বিরুদ্ধে হিন্দু প্রতিরােধের জোড়ালাে সংকল্প গােটা সমাজে ছড়িয়ে পড়ুক — এই আশা নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি । বাংলার ৩৬ হাজার গ্রামে হিন্দু সংহতির দশ টাকার সদস্য হওয়া কর্মীরা থাকবে না , কিন্তু হিন্দু সংহতির নাম নিয়ে লড়াইতে এগিয়ে যাওয়ার মত প্রেরণা ও মনােবল যুবকরা পাবে — এটাই প্রত্যাশা । এবার ১৪ ই ফেব্রুয়ারীর সমাবেশে ও তার প্রস্তুতিপর্বে এর আভাস আমি দেখতে পেয়েছি ।
কিন্তু সব পূর্বাভাসই শেষ পর্যন্ত বাস্তবে পরিণত হয় না । তাই হিন্দু প্রতিরােধের আজকের এই পূর্বাভাসকে রাজ্যব্যাপী বাস্তবে পরিণত করতে হলে আরও অনেকটা রক্ত ও ঘাম ঝরাতে হবে ; আরও অনেক মূল্য দিতে হবে । প্রাথমিক পর্যায়ে এই কাজটা সংগঠনের দ্বারাই করতে হবে । কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে সংগঠনের কাঠামােকে বেশি গুরুত্ব দিলে তা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে বলে আমি মনে করি । ২০১১ পূর্ব মমতা ব্যানার্জী সিপিএম বিরােধী কোন মজবুত সংগঠনের নেত্রী ছিলেন না । তিনি ছিলেন সিপিএম বিরােধিতার একটি প্রতীক । পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত কোন গ্রামে যেখানে কোনদিন মমতা ব্যানার্জীর পা পড়ে নি এবং পড়বেও না , সেখানেও মানুষ সিপিএম – এর অত্যাচার ও দলবাজির বিরুদ্ধে লড়াইতে এগিয়ে গেছে শুধুমাত্র মমতার নাম নিয়ে । আমি জানি আজকের পরিস্থিতিতে মমতা ব্যানার্জীর উদাহরণ দেওয়া অনেকেরই ভালাে লাগবে না । কিন্তু লােককে সন্তুষ্ট করা আমার কাজ নয় । জনগণকে সন্তুষ্ট করে ভােট পাওয়া যায় , তাদেরকে রক্ষা করা যায় না । তাই সমসাময়িক উদাহরণ হিসাবে মমতা ব্যানার্জীর নাম আমি নেবই । মমতা ব্যানার্জী সিপিএম-এর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোন শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তােলেন নি , হয়তাে পারেন নি । কিন্তু তাঁর জেদ , অদম্য সাহস ও সিপিএম বিরােধিতায় আন্তরিকতার জন্য তিনি সিপিএম – এর অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন । ঠিক তেমনি হিন্দু সংহতিও যদি মুসলিম অত্যাচারের বিরুদ্ধে হিন্দুর আত্মরক্ষা ও আত্মসম্মান রক্ষার লড়াইয়ের একটা প্রতীক হয়ে উঠতে পারে তবেই একাজে সাফল্য আসবে । ইতিহাস থেকে আরও দুটো উদাহরণ নেওয়া যায় । ১৫ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্যর ভক্তি আন্দোলন এবং গান্ধীজীর লবণ সত্যাগ্রহ ( ১৯৩০ ) ও ভারতছাড়াে ( ১৯৪২ ) আন্দোলন । এ দুটোই শক্ত সাংগঠনিক কাঠামাের উপর দাঁড়িয়ে ছিল না । একটা ভাবপ্রবাহ গােটা জাতির মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল । বিহারের সব থেকে অনগ্রসর ‘ দোসাদ ’ এবং অন্যান্য জাতির মানুষের মধ্যেও গান্ধীবাবার স্বাধীনতা আন্দোলন এক আলােড়ন তুলেছিল ।
তাই আমার ধারণা , শক্ত সাংগঠনিক পরিকাঠামাে দিয়ে নয় , হিন্দুরক্ষার বার্তা নিয়ে হিন্দু প্রতিরােধকে আন্দোলনের আকারে রূপ দিতে হবে যা নিজের গতিতে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়বে । এইভাবে ইসলামিক আগ্রাসী শক্তিকে পরাস্ত করেই একমাত্র পশ্চিমবঙ্গকে বাঁচানাে যেতে পারে । এছাড়া অন্য কোন পথ আমি দেখতে পাচ্ছি না ।
সংকলন শুভঙ্কর নাগ
সংগৃহীত স্বদেশ সংহতি সংবাদ মার্চ ২০১৫
Collected by Subhankar HA Nag
