লেখক পথপ্রদর্শক মাননীয় তপন ঘোষ
ভারতের অনেকরকমের দুর্ভাগ্য আছে । তার মধ্যে একটা বড় দুর্ভাগ্য হল এই যে , ভারতের সাধারণ মানুষ যা ভাবে , আমাদের নেতারা তা ভাবেন না , দলগুলাে তা ভাবে না , সংস্থা ও সংগঠনগুলি তা ভাবে না । ফলে মানুষের আচরণ একরকম , দল , সংস্থা ও সরকারের আচরণ আর একরকম । অথচ এদেরকে আমরা সাধারণ মানুষই নির্বাচিত বা মনােনীত করি । করি কেন ? কারণ বিকল্প নেই , অথবা করতে বাধ্য হই । বুঝিয়ে বলা একটু কঠিন । তবু চেষ্টা করছি । একটি লােকসভা কেন্দ্রে ধরা যাক ১০ লক্ষ ভােটার । সেই কেন্দ্রে ভােটে লড়তে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রার্থীরা এক একজন খরচ করছেন ৫ কোটি , ১০ কোটি বা তারও বেশি টাকা । এই টাকা দিয়ে বিপুল প্রচারের দ্বারা তারা মানুষকে প্রভাবিত করছেন , ছােট ছােট গােষ্ঠী ( ক্লাব ইত্যাদি ) ও সামাজিক অংশ ( জাতি বা কাস্ট ) গুলিকে ঘুষ দিচ্ছেন , সংবাদমাধ্যম ও প্রশাসনকে প্রভাবিত করছেন , গুণ্ডাশক্তিকে কাজে লাগাচ্ছেন । তারপর শেষ রাতে মদ ও টাকার বাণ্ডিল বিতরণ তাে আছেই । এরপরেও মানুষের সত্যিকারের মনের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন — সে আশা করা যায় কি ? তাই আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আসলে কোন না কোন অর্থগােষ্ঠীর মনােনীত প্রতিনিধি । ওই মানিব্যাগদের অনুমােদন ছাড়া এই এম.এল.এ. , এম.পি. দের কিছু করার স্বাধীনতা নেই ।
তাই যখন গত ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে ভারতের সীমার মধ্যে ঢুকে পড়ে আমাদের দু’জন জওয়ান ল্যান্সনায়েক সুধাকর সিং ও ল্যান্সনায়েক হেমরাজ সিং – কে ধরে নিয়ে গেল , তাদের উপর চূড়ান্ত নৃশংস অত্যাচার করল , তাদের গায়ে জেহাদী নিষ্ঠুরতার চিহ্নগুলাে এঁকে দিয়ে ওই দুজনের মৃতদেহ ফেরৎ দিল যাদের মধ্যে একজনের মাথা কাটা অবস্থায় — তখন সারা ভারতে হিন্দুদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি যে চরম আক্রোশ ও ঘৃণা তৈরি হল , তার কোন প্রতিফলন ভারত সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে দেখা গেল না । এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাটা ঘটেছিল কাশ্মীরের পুঞ্চে । এই পুঞ্চের সঙ্গে আমার পরিচয় ও যােগাযােগ একটু বেশি । এই ঘটনার ঠিক পরেই আর একটি ঘটনা ঘটল যা হয়ত অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গিয়েছে , কিন্তু আমাকে তা স্তম্ভিত করে দিল । দেশের সাধারণ মানুষের আবেগ ও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে বিরাট তফাৎ দেখে , সরকারের সংবেদনশীলতার অভাব দেখে আমি ছটফট করতে লাগলাম । পুঞ্চ থেকে একটি চমৎকার পাকা রাস্তা পাকিস্তানের রাওয়ালকোট পর্যন্ত গিয়েছে । মাঝে চেকপোস্ট । ওই রাস্তা দিয়ে সপ্তাহে একদিন একটি বা দুটি করে বাস যাত্রী নিয়ে পাকিস্তান থেকে ভারতে ( পুঞ্চে ) আসে । পরেরদিন ফিরে যায় । এছাড়া ওই রাস্তা দিয়ে পণ্যবাহী ট্রাক যাতায়াত করে । কি কি পণ্য আসে অথবা আদৌ কিছু আসে কিনা আমি জানি না । কিন্তু এখান থেকে শাকসব্জী , ফলমূল , মাছ ইত্যাদি বহু পণ্য পাকিস্তানে যায় । পাকিস্তানী সৈন্যদের ওই নােংরামি ও বেয়াদপিপূর্ণ ঘটনা অর্থাৎ আমাদের সৈন্যদের মাথাকাটা মৃতদেহ ফেরত দেওয়ার পর সংবাদপত্রে জানতে পারলাম যে পাকিস্তান পুঞ্চ বর্ডারে গেট বন্ধ করে দিয়েছে এবং আমাদের দেশের কাঁচামাল বােঝাই ২৫ টি ট্রাক সীমান্তে আটকে পড়েছে । আর ওই ট্রাকগুলির ড্রাইভাররা হায় হায় করছে তাদের মাল পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে । খবরটা এটুকুই । কিন্তু আমার মাথায় যেন আগুন ধরে গেল আমাদের শাসকগােষ্ঠীর আত্মসম্মানবােধহীনতা দেখে । পাকিস্তান আমাদের এতবড় অপমান করল , আমাদের সেনাদের উপর এতবড় নৃশংস পাশবিক অত্যাচার করল , তারপরে কোথায় আমরা অন্ততঃ একটুখানি প্রতীকী প্রতিবাদ দেখাব সাময়িকভাবে হলেও গেট বন্ধ করে দিয়ে , তা নয় , পাকিস্তানই গেট বন্ধ করে দিচ্ছে । যেন আমরা অপরাধী আর ওরা প্রতিবাদ জানাচ্ছে । আর আমাদের ড্রাইভাররা মাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে কাঁদছে । অর্থাৎ ভারত সরকারের আচরণ প্রমাণ করে দিল ২৫ ট্রাক কাঁচামালের দামের চেয়েও ভারতের সম্মানের দাম কম । এই মনমােহন সিংয়ের মত লােকগুলাে তাড়াতাড়ি মরেনা কেন বলতে পারেন ? নাকি ক্রীতদাসদের আয়ু বেশি হয় ? সােনিয়া গান্ধীর এই ক্রীতদাস বিজিগীষু শিখ জাতির সম্মান তাে ডুবিয়েইছে , গােটা ভারতের সম্মান যে ধূলায় লুটিয়ে দিল । ভারতের ওই এতবড় অপমানের কথা জানার পর কি উচিত ছিল না ভারত পাকিস্তান বর্ডারে যতগুলি গেট বা চেকপােস্ট আছে — সেগুলি মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া ? তাতে যদি আমাদের অনেক বেশি আর্থিক ক্ষতি হয় তাও ! এটা তাে ন্যূনতম প্রতিবাদ । তারপর তাে ওই ঘটনা প্রতিকারের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা । উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ তাে দূরের কথা , প্রতীকি প্রতিবাদটুকুও করার মত ক্ষমতাবা ইচ্ছা নেই এই ক্রীতদাস মনমােহন সিংয়ের ।

এইবার একটা কথা পাঠককে জানানাে দরকার । আমাদের দেশের সেনাবাহিনী প্রফেশনাল এবং তাদের রাজনীতিকরণ হয়নি । তারা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মত রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঙ্খী নয় । তারা সরকারের অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতৃত্বের আদেশ মেনে চলে । কিন্তু এবার মানেনি । তারাও সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছে । সােনিয়া-মনমােহন সিংয়ের সরকার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার কথা চেপে যেতে চেয়েছিল । আমাদের দুই সৈন্যের উপরে নাপাক্ পাকি-রা যে নৃশংস অত্যাচার করেছে ( কোন আন্তর্জাতিক আইনের পরােয়া না করে ) , একজনের মাথা কেটে নিয়েছে , এই তথ্যগুলিকে চেপে যেতে চেয়েছিল ভারত সরকার । কিন্তু এইবার আমাদের সেনাবাহিনী তাদের চিরাচরিত রীতিকে লঙ্ঘন করে মিডিয়ার সামনে প্রকাশ করে দিল পাক জেহাদী নৃশংসতার কাহিনী । তাই দেশ জানতে পারল ।
পাকিস্তানের পাপ , পাকিস্তানের দুষ্কাৰ্য্য , পাকিস্তানের পাশবিক আচরণ , পাকিস্তানের নৃশংসতা — এসবকে ঢেকে রাখার পরম দায়িত্ব যেন আমাদের , ভারতের । এই রােগ শুধু মনমােহন সিংয়ের নয় , এই রােগ আমাদের গােটা রাজনৈতিক শ্রেণীর । এই প্রসঙ্গে ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের কথা উল্লেখ না করলে একপেশে বিচার করা হবে । তখন প্রধানমন্ত্রী জনপ্রিয় অটলবিহারী বাজপেয়ী । তিনি লাহােরে নিয়ে গেলেন শান্তির বাস । আর তারা আমাদের পিছনে ঢুকিয়ে দিল কারগিল । বাজপেয়ীর শান্তিপ্রয়াসের মূল্য ভারতকে দিতে হল ৫২৭ জন সৈন্যের প্রাণ হারিয়ে । তারসঙ্গে অপরিসীম অর্থক্ষতি । নিজেদের অসাবধানতায় হারানাে নিজেদের জমিটুকু মাত্র ফিরে পেতে এই মূল্য দিতে হল আমাদেরকে । যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান ফেরৎ দিল যুদ্ধের শুরুতেই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া আমাদের ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়া ও পাঁচজন জওয়ানের মৃতদেহ , যারা সীমান্তে নজরদারি করতে গিয়ে পাকিদের হাতে ধরা পড়েছিল । এই ছ’জন ভারতীয় সৈন্যের উপরেও করা হয়েছিল চরম ও নৃশংস অত্যাচার । তাদের শরীরেও এঁকে দিয়েছিল পাকি-রা জেহাদী নিষ্ঠুরতার চিহ্নগুলি । পুত্রের শরীরে অত্যাচারের ঐ চিহ্ন দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়ার পিতা এন কে কালিয়া , যিনি নিজেও একজন সৈনিক ছিলেন । তিনি ভারত সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন তাঁর ছেলের মৃতদেহের পােস্টমর্টেম রিপাের্ট তাঁকে দিতে । কিন্তু বাজপেয়ীর ভারত সরকার সে রিপাের্ট দেয়নি ও প্রকাশ করেনি । অর্থাৎ পাকিস্তানের পাপ চেপে রাখার দায়িত্ব পালন করেছিলেন যে দায়িত্ব আজ মনমােহন সিং পালন করছেন । সৌরভকালিয়ার বাবা দমে যাননি । তিনি তখন থেকে এই দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে জনমত তৈরি করছেন ঐ রিপাের্টটি সরকারিভাবে হাতে পাওয়ার জন্য , যাতে তিনি বিশ্বের সামনে পাকিস্তানী জেহাদী নৃশংসতার কথা প্রমাণসহ তুলে ধরতে পারেন । এবার ভারতীয় সৈন্যের মাথা কাটার ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ পাওয়ায় সাধারণ মানুষ ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়ার কথাও কিছুটা জানতে পেরেছেন । আরও জানা গিয়েছে যে ২০০৯ সালেও এরকমই আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল । এর থেকেও বড় ঘটনা , ভারতকে এর থেকেও বড় আঘাত দিয়েছিল বাংলাদেশ । তাও বাজপেয়ীর আমলেই ২০০১ সালে । মেঘালয় বর্ডারে ১৬ জন বি.এস.এফ. জওয়ানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে জানােয়ারের মৃতদেহের মত বাঁশে করে টাঙিয়ে ফেতে দিয়েছিল । সেই অপমানও আমাদেরকে মুখ বুজে হজম করতে হয়েছিল , কারণ বাজপেয়ীজীর উদার ইমেজের মূল্য আমাদের জাতীয় সম্মানের থেকেও বেশি ।
ভারতের দুই পাশে দুই ইসলামিক প্রতিবেশী , যারা ভারতের অঙ্গ থেকেই উদ্ভূত — তাদের এই নিষ্ঠুর , নৃশংস ও অপমানজনক আচরণ আমাদেরকে সহ্য করে যেতেই হবে আমাদের আত্মসম্মানহীন নেতৃত্বের জন্য । জাতির আবেগ ও মান অপমান বােধের সঙ্গে এই নেতৃত্বের কোন সম্বন্ধ নেই । এরা একটা অন্য শ্রেণী । নিউ ইয়র্কে বা দুবাইতে , সিঙ্গাপুরে বা হংকংয়ে মদের গ্লাস হাতে নিয়ে ভারত-পাকিস্তান সব নেতৃত্ব একাকার হয়ে যায় ।
http://www.facebook.com/suparhumanTAPANGHOSH/
আমাদের দেশের সবথেকে বড় সংবাদপত্র গােষ্ঠী টাইমস অফ ইন্ডিয়া । কোথা থেকে রিমােট কন্ট্রোলের বােতামে চাপ পড়ল কে জানে — ওই পত্রিকা খবর সংগ্রহ ছেড়ে দিয়ে ‘ আমন্ কী আশা ’ অভিযান নিয়ে খেপে উঠল । আমন্ উর্দু শব্দ , মানে শান্তি । ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি স্থাপনের সব দায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিল । কাগজে খবরের জায়গা ছােট হয়ে গেল । শুধু ভারত আর পাকিস্তানের মানুষরা কতটা শান্তিকামী , পাকিস্তানীরা ভারতকে কতটা ভালবাসে , ভারতবাসীর সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য তারা কি ছটফট করছে — এসব দেখাতে তারা ইংরাজী সংবাদপত্রের পাতার পর পাতা ভরিয়ে ফেলল । আমাদের এইসব ইংরাজী জানা বুদ্ধিজীবিদের এই ভণ্ডামি আর ধৃষ্টামাে আমাদের দেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে দিচ্ছে । এই টাইমস অফ ইন্ডিয়া কি একবারও খোঁজ নিয়েছে যে ভারতীয় সৈন্যের গলা কাটার ঘটনাকে পাকিস্তানের কত মানুষ , কতগুলি সংস্থা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা করেছে ? যে কোন আন্তর্জাতিক পেশাদারী সমীক্ষা সংস্থাকে দিয়ে এই বিষয়ে পাকিস্তানে একটা জনমত সমীক্ষা করালাে না কেন টাইমস অফ ইন্ডিয়া ? তাহলেই দুধ ও জল আলাদা হয়ে যেত । বােঝা যেত পাকিস্তানীদের ভারতপ্রেমে কতটা দুধে কতটা জল । যাক , পাকিস্তানের গাদুনি খেয়ে ‘ আমন্ কি আশা ’ – র ন্যাকামি এখন বন্ধ হয়েছে ।
এইসব সংবাদমাধ্যমের মালিক পক্ষ বা পরিচালক গােষ্ঠী আর আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব — এরা সব একই শ্রেণীভুক্ত । দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খা-আবেগের সঙ্গে এদের কোন যােগ নেই । এদেরই সঙ্গে যুক্ত আছে এলিট ক্লাস ও বুদ্ধিজীবি শ্রেণী । এটাই আমাদের দেশের আমাদের জাতির বড় দুর্ভাগ্য । এই দুর্ভাগ্য দূর করতে , দেশে মানুষের আবেগের সঙ্গে যুক্ত ও সংবেদনশীল নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে । নতুন প্রজন্মের কাছে এটাই আমার আশা ।
সংকলন শুভঙ্কর নাগ
সংগৃহীত স্বদেশ সংহতি সংবাদ মার্চ ২০১৩
