তপনদা আমাকে কতভাবে সাহায্য করেছেন । তা অল্প কথায় বলে শেষ করা যাবে না । গত ৪০ বছর আমি তপন ঘােষের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম । ১৯৭৮ সালে আমাদের কাটোয়ার বাড়িতে । তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ওখানকার স্বয়ংসেবক চৈতন্যদার মাধ্যমে । খাকি ড্রেসের প্রতি আমার ছােটোবেলা থেকেই তীব্র আকর্ষণ ছিল । এনসিসি আর স্কাউট করতাম । রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরির হাতে মেডেলও পেয়েছি । তাই গণবেশে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করি । ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পরেও দ্বিখণ্ডিত ভারতে হিন্দুদের দুর্দশাই আমাকে তপনদার কাছে পৌঁছে দিয়েছিল । মেডিক্যাল কলেজের দিনগুলিতেও তপাদার সঙ্গে আমার যােগাযােগ ছিল। কলুটোলার রাস্তা হয়ে বৈঠকখানা রােডের বাসায় যাওয়া – আসা করেছি বহুবার । সেখানে অনেককটি ক্ষুধার্ত ছেলে – মেয়ের কথা ভেবে একগাদা সিঙ্গারা , জিলিপি , মুড়ি ও চপ কিনে নিয়ে যেতাম তার বাসায় । দীপক গাঙ্গুলি , প্রকাশ দাস , শচীনদা ( সিংহ ) যেমন আমার কলকাতার ফ্লাটে এসেছে , তেমনই তথাগত ও তপনদারও পদধূলি পড়েছে । ২০১৯ – এর নভেম্বরে আমার মা শয্যাশায়ী । দেবতনুদা ও তপনদা অর্থ সংগ্রহের জন্য এলে ফিরিয়ে দিতে পারিনি । সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের মাড়ােয়ারি ভবনে অনেক মিটিঙে আমি তপনদার পাশে থেকেছি । আমার মতাে একটুতেই মাথা গরমের মানুষ দাদার কাছে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করা শিখেছি । পূর্বস্থলীর শিবিরে , বর্ধমানের টাউনহলে , কলকাতার মৌলালিতে , রানি রাসমণি রােডের মিছিলে আমি দাদার সঙ্গে থেকেছি । ২০০৭ সালে বেলেঘাটায় তাঁর বােনঝির বিয়েতে আমি বেনারসি শাড়ি নিয়ে গেলে আপত্তি করেছিলেন । গত বছর নভেম্বর মাসে আমি , মা ও তপনদা একসঙ্গে ট্রেনে চেপে আমাদের গ্রামের বাড়ি ধুলিয়ানে গেছিলাম । রাস্তায় অনেক সুখ – দুঃখ ও পরিকল্পনার কথা হয়েছিল । আমি ইজরায়েল যেতে চাইলে তিনি নিষেধ করেছিলেন । গত জানুয়ারিতে আমার মা গত হলে তিনি আমাকে অনেকক্ষণ সান্ত্বনা দিয়েছিলেন । নেপালে আমার কাছে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন । কর্মপাগল মানুষটির সেই আশা অপূর্ণই থেকে গেল । দেওঘরের আশ্রমে আমার থাকার ব্যবস্থাকরে দেবেন বলেছিলেন । খুব বড়ো ডাক্তার বলে সব জায়গায় আমার পরিচয় করে দিতেন । দেশভক্ত , পরােপকারী এই বঙ্গবীরকে প্রণাম করতে চাইলে নিষেধ করতেন । কারাে বিরুদ্ধে কোনােদিন অভিযােগ করেননি । ২০১৩ সালে গোয়াতে সনাতন সংস্থার হিন্দু অধিবেশনে আমি কিছু অর্থ তাঁর হাতে দিয়ে বলেছিলাম যাকে মনে হবে তাকে দিয়ে দেবেন –এতটাই ভরসা করতাম তপনদার ওপর । আমেকিায় গেলে আমার সঙ্গে নারায়ণ কাটারিয়ার কথা বলিয়ে দেন তিনি । শিবপ্রসাদ রায়ের পুস্তিকা গুলির সংকলন করার প্রস্তাব আমিই তপনদাকে দিয়েছিলাম । বলেছিলাম , টাকা আমি দেব । আমি বহুবার সূর্যসেন স্ট্রিটের এটিএম থেকে টাকা তুলে তার পকেটে গুঁজে দিয়েছি । জানতাম তার তার প্রয়ােজনের কথা । অনেক মানুষজনের মুখের ভাতের ব্যবস্থা করতে হয় তাকে । ২০১৪ সালে আমি মসিশাসে থাকার সময় তাঁকে হিমাংশুদার প্রেস থেকে দশহাজার গীত ছাপিয়ে পাঠাতে বলেছিলাম । তপনদা নিজের টাকা খরচ করে সেই গীতা আমার ফ্লাটে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন । সেই তপনদাকে কি ভুলতে ভােলা যায় । আমার সহোদর ভাই – বােন নেই । কিন্তু তিনি বড়দার মতাে আমার আপনজন ছিলেন । দুর্মুখেরা যাই বলুক , তিনি অনেক বড় মাপের মানুষ ছিলেন । তাঁর ত্যাগ তিতিক্ষার সামনে নিজেকে বড়াই ছােটো মনে হতাে । তিনি চিরদিন আমার অনুপ্রেরণার স্রোত হয়ে থাকবেন । তাকে আমার শতকোটি প্রণাম । স্বস্তিকা । লেখক ডাঃ রবীন্দ্রনাথ দাশ । ১১ শ্রাবণ -১৪২৭ ।। ২৭ জুলাই -২০২০