হিন্দু মিলন সংঘের পক্ষ থেকে ত্রিবেণী মহাকুম্ভে আগত সকল সাধু-সন্ত ও পুন্যার্থীদের এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে নতমস্তকে প্রণাম জানাই ত্রিবেণী মহাকুম্ভকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য।

ত্রিবেণী মহাকুম্ভ ফেব্রুয়ারীর ১২,১৩,১৪ তারিখে পূর্ণ স্নান সম্পন্ন হল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কুম্ভ মেলাকে স্বীকৃতি প্রদান করলেন।

ত্রিবেণী হল ভারতের পশ্চিমঙ্গ রাজ্যের হুগলী জেলার বাঁশবেড়িয়া পৌরসভার উত্তরাংশে অবস্থিত একটি ছোট নগর। বহু শতাব্দী ধরেই এটি হিন্দুদের জন্য একটি পবিত্র স্থান। এই স্থানের পবিত্রতা বহু শতাব্দী ধরে স্বীকৃত হয়ে আসছে এবং ১২ শতকের শেষে ধোয়ীর লেখা সংস্কৃত কাব্য পবনদূতমে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের প্রাথমিক পর্যায়ে ত্রিবেণী শহর অধিগৃহীত হয়েছিল।

ত্রিবেণী সঙ্গম গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর মিলনে তৈরি হয়েছিল‌। কিন্তু ইতিহাসের সেই দিন আর নেই। যমুনা নদীর শাখা-প্রশাখা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। অতীতের যে নদীর উপর ভিত্তি করে পর্তুগিজ ও ফরাসীরা বন্দর স্থাপন করে ব্যবসা করত, সেই সরস্বতী নদী যেন ছোট এক খালে পরিণত হয়েছে। ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ আসতেন।

ত্রিবেণী অর্থে তিন নদীর সঙ্গমস্থল বা মিলনবিন্দু। ভারতের উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে (পূর্বতন এলাহাবাদ) গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর মিলনস্থলটি হিন্দুদের তীর্থস্থান হিসাবে পরিচিত। এটিকে ত্রিবেণীসঙ্গম বলা হয়। পুরাণমতে, এই ত্রিবেণীতে সরস্বতী নদী অন্তঃসলিলা অবস্থায় যমুনার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখানে প্রতি ১২ বছরে একবার করে কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও এখানে অনেক ভারতীয় রাজনীতিবিদের দেহভস্ম ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর দেহভস্ম এখানেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ভারতবর্ষে অপর একটি ত্রিবেণীসঙ্গম আছে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার সপ্তগ্রামের নিকট ত্রিবেণী নগরীতে। এখানেও গঙ্গা বা ভাগীরথীর সঙ্গে অপর দুই নদী যমুনা (পশ্চিমবঙ্গ) ও সরস্বতী নদী মিলিত হয়েছে।

ত্রিবেণী শহরের অবস্থান হল ২২.৯৯° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৪০° পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। যমুনা, গঙ্গা ও সরস্বতী নামে তিনটি নদীর মিলন থেকে ত্রিবেণী নামটি পাওয়া যায়। আগে নাম ছিল “মুক্তবেণী”, এটি প্রয়াগ থেকে এসেছে, এটি যুক্তবেণী নামেও পরিচিত। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে জেমস রেনেলের বাংলার মানচিত্রে “টেরবোনি” নামে অভিহিত করা হয়েছিল। বিখ্যাত হিন্দু দার্শনিক এলাকা “শ্মশানঘাট”-এর পাশ দিয়ে সরু নদীখাতে প্রবাহিত হত সরস্বতী নদী যা ছিল সপ্তগ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমে। পড়ে এই নদীপথ ছেড়ে গঙ্গা নদী বিশেষ করে হুগলি বা ভাগীরথী নামে পরিচিত হয়ে সমুদ্রে মিলিত হয়। ঘাটটি ভূরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের মহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি দ্বারা নির্মিত, যা ঘাটের কাছাকাছি ত্রিবেণীর মন্দিরগুলিতে গৌড়ীয় রীতির দৃশ্যমান প্রভাব ফেলেছিল। অতীতে যমুনা নদীটি গঙ্গার (হুগলী নদী) শাখা হিসাবে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে নদীটি গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

এই শহরটি মালভূমি ও পাহাড়ের নৈকট্য থেকে দূরে গঙ্গার পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলে অবস্থিত এবং এখানকার জাফর খান গাজী মসজিদ হল পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের নিকটতম অতীতের বেঁচে থাকা স্মৃতিস্তম্ভগুলির একটি। মসজিদটির একটি আরবি ক্রমবিন্যাস রয়েছে ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দ, যদিও প্রমাণ পাওয়া যায় যে এটি সময়ের সাথে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। তারিখটি আরও দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয় যে ১২৭২ সালে মুসলিমদের বাংলার বিজয়ের প্রায় ৬০ বছর পর, নিকটবর্তী এলাকাগুলির সাথে “ত্রিবেণী” জনপদটি জাফর খান কর্তৃক দখল ছিল। মসজিদটির দরজাগুলিতে সনাতন বৈষ্ণব ভাস্কর্য খোদিত রয়েছে, যা থেকে অনুমান করা হয় যে মন্দিরের উপর সম্ভবত মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল।

শোনা যায়, স্বয়ং মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব ত্রিবেণীর ঘাটে পদার্পণ করেছিলেন । ত্রিবেণীর কালীতলা নামক স্থানে সনাতন ধর্মের দেবী মা কালীর একটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে । বহুদিন অসংখ্য ভক্তগণের সমাবেশ ঘটে এই মন্দিরে। লোকমুখে শোনা যায়, ঐতিহাসিক নীল বিদ্রোহে(১৮৫৯-১৮৬০) অংশগ্রহণকারী দুই ভাই রঘুনাথ সর্দার ও বিশ্বনাথ সর্দার (বিশে ডাকাত) এই বাঁশবেড়িয়া-ত্রিবেণী এলাকার বাসিন্দা ছিলেন ও তারা প্রাচীন কালীমন্দিরে ডাকাতির পূর্বে উপাসনার জন্য আসতেন ।

মনসামঙ্গলে চাঁদ সওদাগরের কাহিনীতে যে নেতা ধোপানির কথা উল্লেখ রয়েছে সেটি ত্রিবেণী গঙ্গা ঘাটের পাশে রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে বেশকিছু পুরানো মন্দির।

যে ত্রিবেণী অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী তিনটি নদীর মিলনস্থল সেই ত্রিবেণী কে নিয়ে এত ইতিহাস এত ধর্মীয় সংস্কৃতি আধ্যাত্মিকতা জড়িয়ে আছে হিন্দুদের অর্থাৎ সনাতন ধর্মের। সেই ত্রিবেণীর কুম্ভ মেলা অর্থাৎ কুম্ভস্নাম বন্ধ হয়েছিল ইসলামিক শাসনকালে।

আজ থেকে ৭০৩ বছর আগে অর্থাৎ জাফর খাঁ গাজী ১৩১৯ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবেণীতে বিষ্ণু মন্দিরকে মসজিদে রূপান্তরিত করে। সেই সময় থেকে কুম্ভস্নান ও মেলা বন্ধ হয়ে যায়।

আজ থেকে এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২১ সালের প্রথম দিকে আমেরিকার কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী, হিন্দুধর্মে সমর্পিতপ্রাণ, মাননীয় শ্রীকান্ত মুখোপাধ্যায় দাদা এবং কাঞ্চন বন্দ্যোপাধ্যায় দাদার সর্বান্তঃকরণের প্রচেষ্টায় এবছর ২০২২ সালে ১১-১৩ ফেব্রুয়ারি কুম্ভ মেলা নতুন করে শুরু করা হয়।

এ বৎস র অর্থাৎ ২০২৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ১২, ১৩ ,১৪ তারিখে কুম্ভ মেলা সুসম্পন্ন করা হয়েছে কুম্ভ মেলা পরিচালনা সমিতি পক্ষ থেকে।

কুম্ভ মেলা ঠিক একমাস আগে ভূমি পূজন করার রীতি আমাদের এই পরম্পরা। পরম্পরা মিনি এ বৎস পহেলা জানুয়ারিতে ২০২৩ এ রবিবার কুম্ভ মেলার ভোগী পূজন করা হয়েছিল।