যেখানে গেছেন সেখানেই কৃতকার্য,

স্বাধীনতার পরে এতোটা ডায়নামিক

জীবন কারোর নেই, সঙ্গে দেশপ্রেম।

সাঁইত্রিশ বছরের মধ্যে উর্দি গায়ে চাপিয়ে ছিলেন মাত্র সাত বছর,বাকি তিরিশ বছর কখনও-কুর্তা পাজামা, আবার কখনও বা লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, অথবা কখনও অন্য কোন

পোশাকেই জনসমুদ্রে মিশে গিয়েছিলেন IB-র আন্ডারকভার এজেন্ট হিসেবে ভারত ও-বিদেশে-গোপন মিশন চালিয়েছেন দীর্ঘ

যুগের পর যুগ তিনি হয়ে উঠেছেন দেশের

একমাত্র সুপার স্পাই ‘অজিত ডোভাল’।

অপারেশন ব্লুস্টারের বদলা হিসেবে শিখ উগ্রপন্থীরা ১৯৮৮ সালে দখল করে নিয়েছিল অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল স্বর্ণমন্দিরকে দখলমুক্ত করার জন্য চালানো হবে মিলিটারি অপারেশন ‘ব্ল্যাক থান্ডার-টু’। এর আগে ১৯৮৪ সালে অপারেশন ব্লুস্টারে নিহত হয়েছিল ৪৮৯ জন শিখ উগ্রপন্থী ও আটক থাকা দর্শনার্থী। সেই অভিযানে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৮৩ জন সেনা ও পুলিশ জওয়ান। উগ্রপন্থীদের বিষয়ে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ না করে অপারেশন চালাতে গিয়ে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার।

স্বর্ণমন্দির।

**************

১৯৮৮ সালেও ঘটেছিল একই ঘটনা। জঙ্গিদের বিস্তারিত তথ্য রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ছিল না। অথচ ‘ব্ল্যাক থান্ডার-টু’ অপারেশন শুরু করার আগে, জানা দরকার জঙ্গিদের সংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণ ও স্বর্ণমন্দির চত্বরে তাদের সঠিক অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য। সমস্যা ছিল আরও এক জায়গায়। জঙ্গিরা স্বর্ণমন্দিরের ভেতর আটকে রেখেছিল বেশ কিছু দর্শনার্থীকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রোমানিয়ার কূটনীতিক লিভিউ রাদু। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যখন স্বর্ণমন্দিরের ভেতরের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ঠিক সেই সময় স্বর্ণমন্দিরের সামনের রাস্তায় একজন অচেনা রিক্সাওয়ালার আবির্ভাব হয়েছিল।

স্বর্ণমন্দির দখল করে নেওয়া জঙ্গিরা।

অচেনা লোক দেখে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল জঙ্গিরা। দিন দশেক নজরে রাখার পর রিক্সাওয়ালাকে জঙ্গিরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল স্বর্ণমন্দিরের ভেতর। ভারতীয় সেনার গুপ্তচর হিসেবে অত্যাচার শুরু করেছিল। কিন্তু রিক্সাওয়ালা চোস্ত উর্দুতে জানিয়েছিল সে পাকিস্তানের এজেন্ট। ভারতীয় সেনার নজর এড়াতেই রিক্সাওয়ালার ছদ্মবেশ নিয়ে এলাকায় ঢুকেছে সে। খালিস্তানি আন্দোলনকে সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানের আইএসআই পাঠিয়েছে তাকে। লুঙ্গি কুর্তা পরা রিক্সাওয়ালা এরপর পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গা, শিখ মহল্লা ও গুরুদ্বারের বিশদ বিবরণ দিয়েছিল। আইএসআই-এর শীর্ষে থাকা কিছু লোকের নাম বলেছিল। শিখ উগ্রপন্থীরা বিশ্বাস করে নিয়েছিল রিক্সাওয়ালা পাকিস্তানেরই মানুষ ও আইএসআই এজেন্ট। তারা রিক্সাওয়ালাকে নিয়ে স্বর্ণমন্দির চত্বর ঘুরে দেখিয়েছিল। দেখিয়ে ছিল কীভাবে ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে তারা।

১৯৮৮ সালের ৯ মে, পাঞ্জাব পুলিশের প্রধান কেপিএস সিং গিলের নেতৃত্বে শুরু করেছিল ‘অপারেশন ব্ল্যাক থান্ডার-টু’। অপারেশনটি চলেছিল ১৮ মে পর্যন্ত। অপারেশনে প্রাণ হারিয়েছিল একচল্লিশ জন উগ্রপন্থী। আত্মসমর্পণ করেছিল দুশো জন। অপারেশন শুরু হওয়ার মুহূর্তে উধাও হয়ে গিয়েছিল সেই আইএসআই এজেন্ট। মন্দির চত্বরে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বর্ণমন্দিরের ভেতর থেকে উগ্রপন্থী সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য পাঞ্জাব পুলিশকে নিখুঁতভাবে সরবরাহ করার পর, অপারেশনের দিন অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিলেন, রিক্সাওয়ালার ভেক ধরা ইন্টালিজেন্স ব্যুরোর অফিসার অজিত ডোভাল।

কেরালা ক্যাডারের আইপিএস ।

****************************

উত্তরাখন্ডে আছে অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পৌড়ি গাড়োয়াল। জেলাটির প্রত্যন্তে লুকিয়ে আছে আছে ঘিরি বানেলসিউন গ্রাম। ১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি, গ্রামটিতে জন্মেছিলেন ভারতের বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত কুমার ডোভাল। বাবা গুণানন্দ ডোভাল ছিলেন সেনাবাহিনীর মেজর। খুব বেশিদিন গ্রামে থাকার সুযোগ হয়নি অজিত ডোভালের। শৈশবেই চলে গিয়েছিলেন আজমেঢ়। ভর্তি হয়েছিলেন কিং জর্জ রয়াল ইন্ডিয়ান মিলিটারি স্কুলে। স্নাতক স্তর পর্যন্ত সেখানেই পড়াশুনা করার পর, ১৯৬৭ সালে আগ্রা ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনমিক্সে মাস্টার ডিগ্রি করেছিলেন।

স্নাতক হওয়ার পর থেকেই পড়াশুনা শুরু করেছিলেন আইপিএস হওয়ার জন্য। ১৯৬৮ সালে সিভিল সার্ভিসেস পরীক্ষায় পাশ করে কেরালা ক্যাডারের আইপিএস হিসাবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ডোভাল। কোট্টায়ামের অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ সুপারের পদে প্রথম পোস্টিং ছিল তাঁর। সেই সময়ে একা হাতে থামিয়ে দিয়েছিলেন থ্যালাইসারির দাঙ্গা। পরবর্তীকালে যোগ দিয়েছিলেন ইন্টালিজেন্স ব্যুরোতে। ভারতের সর্বকনিষ্ঠ আইপিএস হিসেবে পুলিশ পদক পেয়েছিলেন ডোভাল। পেয়েছিলেন ‘প্রেসিন্ডেন্ট পুলিশ পদকও। তিনিই ভারতের প্রথম পুলিশ অফিসার যিনি কীর্তিচক্র সম্মান পেয়েছিলেন। তাঁর আগে পদকটির প্রাপকেরা ছিলেন সেনাবাহিনীর অফিসার।

মোট সাঁইত্রিশ বছর পুলিশ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীতে কাজ করার পর, ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণ করেছিলেন ইন্টালিজেন্স ব্যুরোর চিফ হিসেবে। যাঁর মুকুটের পালকগুলি আজ কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছে।

■ মিশন নর্থ ইস্ট (১৯৮৬)

*****************************

১৯৬৬ সাল থেকে মিজোরামে শুরু হয়েছিল মিজো বিদ্রোহ। মিজো বিদ্রোহ যখন মধ্যগগনে, অজিত ডোভাল তখন ভারতের উত্তর-পূর্বে, ইন্টালিজেন্স ব্যুরোর মাঝারি মাপের অফিসার। মিজো ন্যাশনাল ফন্টের অবিসংবাদী নেতা লালডেঙ্গাকে কিছুতেই শান্তি চুক্তিতে সই করানো যাচ্ছিল না। এগিয়ে এসেছিলেন অজিত ডোভাল। লালডেঙ্গা তখন ঘাঁটি গেড়েছিলেন মায়ানমারের আরাকান এলাকার পার্বত্য অঞ্চলে। জঙ্গল পাহাড় পেরিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অজিত ডোভাল পৌঁছে গিয়েছিলেন জঙ্গিদের ক্যাম্পে। মিজো নেতাকে রাজি করানোর জন্য।

জঙ্গিদের ক্যাম্পে কাটিয়েছিলেন বেশ কিছু দিন। পরের কাহিনি শুনুন খোদ লালডেঙ্গার মুখ থেকে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ক্যাম্পে আমার সঙ্গে ছিল মিজো ন্যাশনাল ফন্টের সাত বিশ্বস্ত কমান্ডার। অজিত ডোভাল ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার সময় আমার সাত কমান্ডারের মধ্যে ছ’জনই চলে গিয়েছিল অজিত ডোভালের সঙ্গে। আমার কাছে আর কোনও উপায় ছিল না। চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হয়েছিলাম।” অজিত ডোভাল লালডেঙ্গাকে নির্বিষ করে দেওয়ার পর, ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক চুক্তি। নিভেছিল কুড়ি বছর ধরে চলা বিদ্রোহের আগুন। লালডেঙ্গা হয়েছিলেন মিজোরামের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী।

■ মিশন – কাশ্মীর (১৯৯০)

******************************

ভারত বিরোধী আন্দোলন মাথা চাড়া দেওয়ায় অজিত ডোভাল ১৯৯০ সালে চলে গিয়েছিলেন কাশ্মীর। কাশ্মীরের বুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মূল মস্তিস্ক ছিলেন ইখওয়ান-ই-মুসলিমিন দলের প্রতিষ্ঠাতা কুকা পারে। চোস্ত উর্দু ও আরবী জানা অজিত ডোভাল মিশে গিয়েছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে। কুকা পারের দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন খোদ কুকা পারেকেই। ফিরিয়ে এনেছিলেন গণতন্ত্রের পথে। এর ফলে ১৯৯৬ সালে কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছিল।

জঙ্গি নেতা কুকা পারে হয়ে গিয়েছিলেন বিধায়ক। যদিও পরবর্তীকালে তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন জঙ্গিদের গুলিতেই। এর পর অজিত ডোভাল ধীরে ধীরে অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে ভারত বিরোধী আন্দোলন থেকে সরিয়ে দিয়েছেন, এঁদের মধ্যে আছেন ইয়াসিন মালিক, শাব্বির শাহ, মৌলবি ফারুক। আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করেছিলেন সৈয়দ আলি শাহ গিলানিকে। হাজার হাজার কাশ্মীরি যুবক মূলস্রোতে ফিরে এসেছিলেন অজিত ডোভালের জন্যেই।

■ মিশন পাকিস্তান ( সময় অজ্ঞাত)

*************************”*******প্রায় সাত বছর পাকিস্তানে কাটিয়েছিলেন অজিত দোভাল। এর মধ্যে ইসলামাবাদের হাইকমিশনে কাটিয়েছিলেন প্রায় ছ’বছর। এক বছর ছিলেন অজ্ঞাতবাসে। এই এক বছর ছদ্মবেশে কাটিয়েছিলেন লাহোরের এক মুসলিম মহল্লায়। দাড়ি রেখেছিলেন। স্থানীয় মসজিদে যেতেন স্থানীয় পোশাক পরে। পাকিস্তানিদের মতোই উর্দু বলতে ও পড়তে পারতেন। গড়গড় করে পড়ে দিতেন আরবি কিতাব। তাই মহল্লার কেউ সন্দেহ করেননি আন্ডারকভার ভারতীয় স্পাই অজিত ডোভালকে।

ওই এক বছরে তিনি আইএসআই ও পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলি সম্পর্কে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। জেনেছিলেন পাকিস্তানের মাটিতে ঘাঁটিগাড়া ভারতবিরোধী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির আয়ের উৎস, তাদের ঘাঁটিগুলির অবস্থান, ঘাঁটিগুলিতে অস্ত্র ও রসদ যাওয়া আসার পদ্ধতি। সংগ্রহ করেছিলেন পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র সংক্রান্ত গুরুত্বপুর্ণ তথ্য। যে তথ্যগুলি পরবর্তীকালে ভারতের কাছে তুরুপের তাস হয়ে উঠেছিল।

লাহোরের এরকমই কোনও মহল্লায় অজ্ঞাতবাসে ছিলেন দোভাল।

অজিত ডোভাল জাতীয়স্বার্থে অজ্ঞাতবাসের দিনগুলির কথা কখনও বিস্তারিতভাবে জানাননি। তবে একটি ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন। অজ্ঞাতবাসকালে একবার প্রায় ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলেন ডোভাল। একদিন তিনি মসজিদে নামাজ পড়ে ফিরছিলেন। মসজিদের বাইরে বসেছিলেন বৃদ্ধ মৌলবী। তিনি ডেকেছিলেন অজিত ডোভালকে। নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর ঘরে। দরজা বন্ধ করে বলেছিলেন, ‘তুমি হিন্দু’। চমকে উঠেছিলেন অজিত ডোভাল। মৌলবীকে দোভাল বলেছিলেন, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে, আমি নিষ্ঠাবান মুসলিম। মৌলবী বলেছিলেন, তোমার কানের লতিতে থাকা ছিদ্র প্রমাণ করছে তুমি হিন্দু।

অজিত ডোভাল যে গ্রামে জন্মেছিলেন, সেখানে পুত্র সন্তানদেরও কানের লতিতে ছিদ্র করার প্রথা ছিল। একটুও না ঘাবড়ে অজিত ডোভাল বলেছিলেন, আমি মুসলমান। ছিদ্রটি জন্ম থেকেই কানের লতিতে আছে। তখন মৌলবী বলেছিলেন, ছিদ্রটা প্লাস্টিক সার্জারি করে বন্ধ করে দাও। নাহলে তোমাকে পাকিস্তানে বিপদে পড়তে হবে। মৌলবীর কথা শুনেছিলেন অজিত দোভাল। প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলেন কানের লতির ছিদ্র। অজিত ডোভাল যে পাকিস্তানের লাহোরে এক বছর লুকিয়ে ছিলেন, তা পাকিস্তান জানতে পেরেছিল ডোভাল পাকিস্তান ছাড়ার পর।

■ মিশন কান্দাহার (১৯৯৯)

******************************

১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দিল্লির দিকে রওনা হয়েছিল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট আইসি-৮১৪। বিমানে ছিলেন ১৭৬ জন যাত্রী এবং ১৫ জন ক্রু। বিমানটি ভারতের আকাশে প্রবেশ করার পর, বিমানটি অপহরণ করেছিল পাঁচ হরকতুল মুজাহিদিন জঙ্গি। অমৃতসর, লাহোর, দুবাই বিমানবন্দর হয়ে বিমানটি অবতরণ করেছিল তালিবান নিয়ন্ত্রিত কান্দাহার বিমানবন্দর। বিমানটি ঘিরে ফেলেছিল সশস্ত্র তালিবানেরা।

হরকতুল মুজাহিদিন জঙ্গিদের দাবি ছিল ভারতের কারাগারে বন্দি জইশ চিফ মৌলানা মাসুদ আজহার, মুস্তাক আহমেদ জারগার ও আহমেদ ওমর সাঈদ শেখের মুক্তি। জঙ্গিদের সঙ্গে ফোনের মাধ্যমে কথাবার্তা শুরু করেছিলেন অজিত ডোভাল। কিন্তু তাদের শর্ত ছাড়া অন্য কোনও শর্তেই বন্দিদের মুক্তি দিতে রাজি হচ্ছিল না জঙ্গিরা। দরকষাকষিতে কেটে যাচ্ছিল দিনের পর দিন। বিমানের ভেতর অসুস্থ্ হয়ে পড়ছিলেন যাত্রীরা। বিমানে ছিল না খাবার, ছিল না জল, ছিল না বিদ্যুৎ।

কান্দাহার বিমানবন্দরে ছিনতাই হওয়া বিমান। ঘিরে আছে তালিবানেরা।

তাদের দাবি মানা হবে না সন্দেহে জঙ্গিরা বিমানের মধ্যে ছুরি মেরে হত্যা করেছিল রুপিন কাটিয়াল নামে এক সদ্য বিবাহিত যুবককে। আহত করেছিল আরও এক যাত্রী সতনাম সিংকে। আরও কিছু যাত্রীকে হত্যা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল জঙ্গিরা। দোভাল তখন সরাসরি কথা বলেছিলেন তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে। এর পর বিমান ঘিরে রাখা তালিবানেরা বিমানে থাকা হরকত জঙ্গিদের জানিয়েছিল বিমানের ভেতর আর কাউকে হত্যা করা যাবে না। এরপর কাউকে আঘাত করা হলে তারা বিমানে ঢুকে পড়বে। শুধু তাই নয়, যাত্রীদের জন্য খাবার ও জলের ব্যবস্থা করেছিল তালিবানরা।

যাত্রীদের প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে, মৌলানা মাসুদ আজহার ও অন্য দুই জঙ্গিকে নিয়ে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর কান্দাহার উড়ে গিয়েছিলেন অজিত ডোভাল ও ভারতের বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিং। হরকতুল মুজাহিদিনের হাতে তিন জঙ্গিকে তুলে দেওয়ার পর বিমানের যাত্রীদের মুক্তি দিয়েছিল বিমান ছিনতাইকারীরা। বিমান ছিনতাইয়ের ১৭৩ ঘন্টা পর।

■ মিশন দাউদ (২০০৫-১৩)

******************************

১৯৯৩ সালের মুম্বাই বিস্ফোরণের পর ডি-কোম্পানি ছেড়ে দিয়েছিল ছোটা রাজন। চলে গিয়েছিল থাইল্যান্ডে। ব্যাঙ্ককে ২০০০ সালে ছোটা রাজনের ওপর প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছিল ডি-কোম্পানি। বদলা নিতে ছোটা রাজন দাউদ ইব্রাহিমকে মারার জন্য নিয়োগ করেছিল তার দুই বিশ্বস্ত হিটম্যান ভিকি মালহোত্রা ও ফরিদ তানাশাকে। দুবাইয়ে ২০০৫ সালে দাউদ কন্যা মাহরুখের বিয়ে হয়েছিল পাকিস্তানি ক্রিকেটার জাভেদ মিঁয়াদাদের পুত্র জুনেইদের সঙ্গে। ২৩ জুলাই দুবাইয়ের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে ছিল রিসেপশন। ছোটা রাজনের গ্যাং সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই পার্টিতেই হত্যা করা হবে দাউদকে।

ভিকি মালহোত্রা ও ফরিদ তানাশা।

সেই মতো ২০০৫ সালে রাজনের দুই হিটম্যান ভিকি মালহোত্রা আর ফরিদ তানাশা চলে এসেছিল ভারতে। দিল্লি থেকে দুবাই উড়ে যাওয়ার কথা ছিল তাদের। খবরটা চলে গিয়েছিল মুম্বাই পুলিশের কানে। মুম্বাই পুলিশের কিছু অংশ দাউদের সঙ্গে ছিল। ফলে মুম্বাই পুলিশ দিল্লি এসে গ্রেফতার করেছিল ছোটা রাজনের হিটম্যানদের। ভেস্তে গিয়েছিল দাউদ হত্যার প্ল্যান। বেঁচে গিয়েছিল দাউদ ইব্রাহিম। উইকিলিকস সংস্থা ২০০৫ সালের ৮ আগস্ট জানিয়েছিল, দাউদ ইব্রাহিমকে হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেই সময়ের ইন্টালিজেন্স ব্যুরোর চিফ অজিত ডোভাল। যদিও ডোভাল ও সরকারের পক্ষ থেকে উইকিলিকসের দাবি অস্বীকার করা হয়েছিল। (https://wikileaks.org/plusd/cables/05MUMBAI1682_a.html )।

উইকিলিকসের কেবলের একটি অংশ।

■ মিশন ইরাক ( ২০১৪)

****************************

২০১৪ সালের জুন মাসে ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নিয়ে ছিল আইসিস জঙ্গিরা। ইরাকের তিরকিতে আটকে পড়েছিলেন হাসপাতালে কর্মরত ৪৬ জন ভারতীয় নার্স। তিরকিত শহরে নৃশংসভাবে গণহত্যা চালাচ্ছিল আইসিস জঙ্গিরা। মৃত্যুভয়ে কাঁপছিলেন নার্সরা। ঈশ্বরকে ডাকছিলেন তাঁদের পরিবার। মে মাসেই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে যোগ দিয়েছিলেন অজিত ডোভাল। জুলাই মাসেই গোপন মিশনে উড়ে গিয়েছিলেন ইরাক। জানা যায়নি এর পর কী ঘটেছিল। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আইসিস জঙ্গিরা ভারতীয় নার্সদের মুক্তি দিয়েছিল। ইরবিল শহর কতৃপক্ষের হাতে ৫ জুলাই তারা তুলে দিয়েছিল ৪৬ জন ভারতীয় নার্সকে। নার্সদের নিয়ে কোচি ফিরে এসেছিল দুটি বিশেষ বিমান।

■ মিশন মায়ানমার (২০১৫)

******************************

নাগাল্যান্ডের এনএসসিএন (খাপলাং) ও মনিপুরের কেওয়াইকেএল জঙ্গি গোষ্ঠীদুটি একসাথে মায়ানমারের পার্বত্য অঞ্চল থেকে এসে চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছিল ভারতীয় সেনার ওপর। ২০১৫ সালের ৪ জুন, মনিপুরের চান্দেল জেলায় ভারতীয় সেনার কনভয়ে আক্রমণ চালিয়ে জঙ্গিরা হত্যা করেছিল ১৮ জন ভারতীয় জওয়ানকে। তৎকালীন আর্মি চিফ দলবীর সিং সুহাগের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল।

নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে এসেছিলেন অজিত ডোভাল। ভারতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত নীতিতে আমদানী করেছিলেন নতুন এক রণনীতি। যার নাম ‘অফেন্সিভ ডিফেন্স’। আগের মতো আর শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করা নয়। শত্রু আক্রমণ করার আগেই শত্রুকে আক্রমণ করে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। ২০১৫ সালের ৯ জুন, ভারতীয় সেনার কম্যান্ডোরা মায়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়েছিল মায়ানমারে। মাত্র চল্লিশ মিনিটের অপারেশনে প্রাণ হারিয়েছিল পঞ্চাশ জনেরও বেশি উগ্রপন্থী। মায়ানমার সরকার ও সে দেশের মিলিটারির সাথে যোগাযোগ রেখে অপারেশনটি সফল করেছিলেন অজিত ডোভাল।

■ সার্জিকাল স্ট্রাইক (২০১৬)

********************************

●২০১৫ সালের ২৭ জুলাই, তিন জইশ-ই-মহম্মদ জঙ্গি সেনা পোশাকে হামলা চালিয়েছিল পাঞ্জাবের গুরুদাসপুরের দিননগর পুলিশ স্টেশনে। জঙ্গিদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন তিনজন সাধারণ নাগরিক ও চার পুলিশকর্মী।

● ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি, পাকিস্তানের মদতপুষ্ট ইউনাইটেড জিহাদ কাউন্সিলের পাঁচ জঙ্গি আক্রমণ চালিয়েছিল ভারতীয় বায়ুসেনার পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে। এই হামলায় শহিদ হয়েছিলেন সাত সেনা ও এক সাধারণ নাগরিক। খতম হয়েছিল পাঁচ জঙ্গি।

● এর পর ২০১৬ সালেরই ১৮ সেপ্টেম্বর, জইশ-ই-মহম্মদ জঙ্গিরা আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিল কাশ্মীরের উরি মিলিটারি ক্যাম্পে। শহিদ হয়েছিলেন ১৯ সেনা জওয়ান। এই তিনটি জঙ্গি হামলার পর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙেছিল ভারতের। উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বৈঠকে ছিলেন অজিত ডোভাল। ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। ভারতীয় সেনার সত্তর জন দুঃসাহসী কমান্ডো আকাশ ও স্থলপথে কাশ্মীরের নওগাম সেকটর দিয়ে লাইন-অফ-কন্ট্রোল পেরিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন পাক অধিকৃত কাশ্মীরে। অতর্কিতে আঘাত হেনে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন সন্ত্রাসবাদীদের ক্যাম্প। মারা গিয়েছিল ষাট থেকে সত্তর জন জঙ্গি ও পাকিস্তানি সেনা।

■ মিশন বালাকোট (২০১৯)

*****************************

২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জইশ-ই-মহম্মদ জঙ্গিদের অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছিলেন চল্লিশ জন সিআরপিএফ জওয়ান। অজিত ডোভালের ফোন গিয়েছিল আমেরিকায়। ফোনের ও প্রান্তে ছিলেন আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোলটন। ( https://theprint.in/…/ajit-doval-had-discussed…/198082/).

বোলটনকে ডোভাল জানিয়েছিলেন ভারত সীমান্ত লাগোয়া ক্যাম্পে কয়েকশো জইশ জঙ্গি আত্মঘাতী মিশনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ক্যাম্পে আছে ট্রেনার ও জইশের সিনিয়ার কমান্ডারা। ডোভালের ফোনটির পর একটি বিজ্ঞপ্তির জারি করে জন বোলটন বলেছিলেন, আত্মরক্ষার অধিকার ভারতের আছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি কাকভোরে খাইবার-পাখতুনখোয়ার বালাকোট ক্যাম্পে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়েছিল ভারতীয় বিমানবাহিনী। বোমায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল জঙ্গিদের ক্যাম্প। প্রাণ হারিয়ে ছিল কয়েকশো জঙ্গি।

ডোভালকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না পাকিস্তান। পাকিস্তানের মাটিতে কিছু ঘটলেই প্রথমে আসে ‘র’ ও ডোভালের নাম। বর্তমানে পাকিস্তানের বুকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে চারটি স্বাধীন রাষ্ট্রের আন্দোলন। স্বাধীন বালোচিস্তান, সিন্ধুদেশ, স্বাধীন আজাদ কাশ্মীর-গিলগিট-বাল্টিস্তান এবং জিন্নাহপুর-মুহাজির সুবা। এ সবের পিছনে ডোভাল ও ‘র’-এর হাত দেখে পাকিস্তান।

পাকিস্তানবিরোধী তালিবান গোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালিবানের সমস্ত আক্রমণের পিছনে ডোভালের হাত দেখে পাকিস্তান।পাকিস্তানের মাটিতে তেহরিক-ই-তালিবান ও আইসিসের গাঁটছড়া বাঁধার পিছনে ডোভালের হাত দেখে পাকিস্তান। এর কারণ সম্ভবত ডোভালের সেই বহুবিখ্যাত উক্তিটি। ২০১৪ সালে তামিলনাড়ুর তাঞ্জাভুরে শাস্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেওয়ার সময় অজিত ডোভাল বলেছিলেন, “আর একটা মুম্বাই (২৬/১১) হলে কিন্তু পাকিস্তানকে বালোচিস্তান হারাতে হবে।”

কৃতজ্ঞতা : আর গোস্বামী