লেখক পথপ্রদর্শক মাননীয় তপন ঘোষ
বহির্ভারত জাগছে । তৃতীয়বারের এই সদ্য আমরিকা সফরের পর এটাই আমার অনুভূতি । ২০১০ এবং ২০১১ – র পর এবছর সেপ্টেম্বর মাসে তিন সপ্তাহের জন্য আমেরিকা ভ্রমণের সুযােগ পেলাম । ১১ , ১২ , ১৩ সেপ্টেম্বর নিউ জার্সিতে হিন্দু স্টুডেন্টস্ কাউন্সিল আয়ােজিত ‘ গ্লোবাল ধর্ম কনফারেন্স ‘ – এর আয়ােজকদের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম একটি প্লেনারী সেশনে বক্তব্য রাখার জন্য । বিষয় ছিল “ ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু নির্যাতন ” । বক্তব্যের থেকেও আমার আগ্রহ বেশি ছিল সকলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাত , মেলামেশা ও ভাব বিনিময়ের জন্য । সেটা পুরােপুরি হয়েছে । আমেরিকার বহু পুরানাে বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে । বহু নতুন পরিচয় হয়েছে আর স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে দেখলাম যে অনেকেই আমাকে চেনে যাদেরকে আমি চিনি না । বারবার অনুভব করতে লাগলাম , স্যোশাল মিডিয়া না থাকলে মুসলমান ও খ্রীষ্টানের দালাল বদমায়েস সেকুলারবাদীরা আমাকে গুঁড়িয়ে দিত ।
এবারের সফরে আমেরিকার মােট সাতটি স্থান ভ্রমণ করেছি । নিউ জার্সি , নিউইয়র্ক , ডালাস , ওয়াশিংটন ডিসি , শিকাগাে , হিউস্টন ও ক্যালিফোর্নিয়া । শহর ধরলে আরও কয়েকটি । যেমন নিউইয়র্কে ম্যানহাটন ও কুইন্স , হিউস্টনে সুগারল্যান্ড , ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোসে ও ফ্ৰীমন্ট । ধর্ম কনফারেন্স ছাড়াও ছােট বড় সভা করেছি মােট আটটি । মােট ন-টি সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছে । এছাড়া অনেত্রে সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ করতে হয়েছে । এরমধ্যে লাঞ্চ আর ডিনারগুলাে বাদ যায়নি । ওয়াশিংটনে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন উচ্চপদস্থ অফিসারের সঙ্গে দেখা করে তাকে পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করেছি । তিনি যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে সব নােট নিয়েছেন ।
আমেরিকায় আমার মেলামেশা ও আদানপ্রদান বেশিরভাগটাই প্রবাসী ভারতীয় হিন্দুদের সঙ্গে হয়েছে । এর মধ্যে দ্বিতীয় প্রজন্মের ভারতীয় , অর্থাৎ যাদের জন্ম আমেরিকায় — তাদের সঙ্গেও হয়েছে । তাদের চিন্তা ও মানসিকতা অবশ্যই আগের প্রজন্মের থেকে আলাদা । তবে তারাও ভারতের সঙ্গে মানসিকভাবে যুক্ত । এটা আমাকে আশ্বস্ত করেছে ।
এবার আমার আমেরিকা সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল ক্যালিফোর্নিয়াতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদীর কার্যক্রম দেখা । ওখানে কার্যক্রম বা সভাকে ‘ ইভেন্ট ‘ বলে । মােদীজীর দুটো ইভেন্ট আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছে , উদ্বেলিত করেছে । আমার সফরের শেষ লগ্নে ২৫ সেপ্টেম্বর আমি ক্যালিফোর্নিয়া পোঁছেছি । ওইদিনই ফ্ৰীমন্ট হিন্দু মন্দিরে আমার জন্য কর্মসূচী ( ইভেন্ট ) আয়ােজন করেছিল আমার তরুণ বাঙালি বন্ধুরা । আঙুলের ডগা দিয়ে যারা পৃথিবীতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসছেন সেই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে বাঙালি প্রতিভার অভাব নেই । নিজ জীবনে তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত ও কেরিয়ারে উজ্জ্বল । সেইরকমই কয়েকজন উৎসাহী কর্মীর প্রচেষ্টায় বাঙালি ও অবাঙালি অনেকেই আমার ২৫ সেপ্টেম্বর সভায় এসেছিলেন । এসেছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার প্রবাসী ভারতীয়দের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি । তারমধ্যে অন্যতম ডঃ রমেশ জাপা । সংঘ পরিবারেরও অনেক কর্মকর্তা বিভিন্ন স্থানে আমার কর্মসূচীতে এসেছেন এবং সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন । আর যাদের কথা উল্লেখ না করলে অপরাধ হয়ে যাবে তাঁরা হলেন আমার সমর্থকদের পত্নীরা । এঁরাও প্রায় সকলেই চাকরি করেন । বাড়িতে বাচ্চাদের দেখাশােনা করেন , রান্নাঘর সামলান । তারপরেও তাঁরা সমান উদ্যমে স্বামীদের সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করেন । এঁদের মধ্যে কারও কারও পিতৃগৃহে অন্য রাজনৈতিক আদর্শের পরিবেশ আছে । কিন্তু আমেরিকায় এঁরা স্বামীদের সহযাত্রী । এছাড়া আমার প্রতি তাঁরা অতি স্নেহশীলা । আমার সুবিধা অসুবিধা দেখাশােনায় তারা কোন ত্রুটি রাখেননি ।
এবারের সফরে হিউস্টনের অনুষ্ঠান বিশেষ করে উল্লেখযােগ্য । বাঙালির প্রাণকেন্দ্র দুর্গাবাড়িতে এই অনুষ্ঠান হয়েছিল ২৩ শে সেপ্টেম্বর শনিবার । অনেক বাঙালি ও অন্য ভাষাভাষী লােকও আমাদের সভায় এসেছিলেন । সকলকে নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় দুর্গামন্দিরে আরতিতে অংশগ্রহণ করলাম । মা দুর্গার অপূর্ব মূর্তি মন ভরিয়ে দিল । পুরােহিত মশায় আলাদা করে আমাকে দিয়ে অঞ্জলি দেওয়ালেন ও মায়ের প্রসাদ দিলেন । আরতির পর পাশের হলঘরে আমার বক্তব্য , পাওয়ার পয়েন্ট ও প্রশ্নোত্তর । তারপর রাত্রিভােজন ওখানেই । এবারই প্রথম অনুভব করতে পারলাম যে উচ্চশিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত আমেরিকাবাসী বাঙালিরাও পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুর অবস্থা নিয়ে চিন্তিত । তাঁরা অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে পশ্চিমবঙ্গকে ইসলামিক আগ্রাসনের হাত থেকে বাঁচাতে তাঁরা কী করতে পারেন । আমার সাধ্যমত তাঁদেরকে উত্তর দিয়েছি ।
নিউইয়র্কে একটি সাধারণ সভা এবং একটি সভা হয়েছে বাংলাদেশী হিন্দুদের সঙ্গে । তাদের সঙ্গে আমার মনের মিল আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে । নিউইয়র্কে ‘ আই টিভি’র স্টুডিওতে গিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছি । নিউইয়র্কের সব অনুষ্ঠানেই নারায়ণ কাটারিয়ার ( সিন্ধ থেকে আগত উদ্বাস্তু ) সক্রিয় সহযােগিতা আমরা পেয়েছি । ডালাস , শিকাগাে এবং ওয়াশিংটনেও আমাদের সমর্থকরা খুব উৎসাহ নিয়ে সব কর্মসূচী আয়ােজন করেছিলেন ।
এবার আসি ২৭ শে সেপ্টেম্বর মােদীজীর কার্যক্রমের কথায় । সকাল ন’টায় ফেসবুক মীট , সন্ধ্যায় বিরাট স্টেডিয়ামে জনসভা । দুটোর জন্যই আগে থেকে পাস দেওয়া হয়েছে । পাস পাওয়া সহজ ছিল না । স্টেডিয়ামের ১৮ হাজার আসনের জন্য ৪৬ হাজার দরখাস্ত এসেছিল ।
সকাল ৯ টায় ফেসবুক ক্যাম্পাসে আয়ােজন । সিকিউরিটির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা , কিন্তু বাড়াবাড়ি নেই । প্রত্যেকের জন্য পাস এবং সরকারী আই – কার্ড বাধ্যতামূলক । আমাদের জন্য পাসপাের্ট । ওটা ফেসবুকের সদরদপ্তর । প্রাঙ্গণে খােলা মাঠে নীচু মঞ্চ । সামনে প্রায় ৬০০ চেয়ার । তার পিছনে একটু উঁচু লম্বা প্ল্যাটফর্মে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার অবস্থান । ভারতের ইংরাজি ও হিন্দি প্রত্যেকটি প্রধান টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা ও অ্যাঙ্কররা উপস্থিত । সব চেনা মুখ । মােদীজী আসার আগে দর্শকদের সাক্ষাৎকার । ক্যালিফোর্নিয়ার মনােরম আবহাওয়ায় রৌদ্র উজ্জ্বল সকালে উৎসাহী ও আত্মবিশ্বাসী ভারতীয় দর্শক । সঙ্গে কৌতূহলী সাদা চামড়ার দর্শক । ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকেরবার্গ ( বয়সে তরুণ ) মােদীজীকে সঙ্গে নিয়ে এলেন । তুমুল করতালির কথা বারবার বলতে গেলে লেখা অকারণে দীর্ঘ হবে । তাই পাঠক বুঝে নিন , মােদীজীর প্রত্যেকটি কথার পর করতালি । অনুষ্ঠানে মােদীজীর টানা বক্তৃতা ছিল না । মার্ক জুকেরবার্গ মােদীজীকে প্রশ্ন করছেন ইংরাজিতে । মােদীজী উত্তর দিচ্ছেন হিন্দিতে । দুদিকে দুটি বড় পর্দায় তা সঙ্গে সঙ্গে ইংরাজিতে অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে । জুকেরবার্গের কয়েকটা প্রশ্ন ছিল স্যোশাল মিড়িয়া সম্পর্কিত । তারপর দর্শকদের মধ্যে থেকে কয়েকজন ( সম্ভবতঃ পূর্ব নির্ধারিত ) প্রশ্ন করলেন । তাঁদের প্রশ্নগুলি ছিল আর্থিক উন্নয়ন , মেক ইন ইন্ডিয়া ও নারী সম্মান সম্পর্কিত । প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তরে মােদীজী ক্রিকেটের ছয় আর চার মেরেছেন । সত্যি অসাধারণ । এবং উত্তরে কোথাও আপােষের মনােভাব নেই । হীনমন্যতার ছোঁয়াটুকু পর্যন্ত নেই । তৃতীয় বিশ্ব ’ , ‘ উন্নয়নশীল দেশ ’ প্রভৃতি পরিভাষাগুলি কেন দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে — মােদীজীকে দেখলে , মােদীজীর কথা শুনলে তা বােঝা যায় । তবে জুকেরবার্গের একটা গুগলি মােদীজী ভালােভাবে সামলাতে পারলেন না । জুকেরবার্গ মােদীজীর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন । প্রথমে মােদীজী সাবলীল ছিলেন । তিনি বললেন যে দর্শকের মধ্যে জুকেরবার্গের মা-বাবা উপস্থিত আছেন । তাঁরা একবার উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে দেখা দিন যাতে সকলে এক কৃতী সন্তানের পিতামাতাকে দেখতে পান । তাঁরা উঠে দাঁড়ালেন সামনের সারি থেকে নয় , মাঝখানের সারি থেকে । তাঁদেরকে প্রণাম জানিয়ে মােদীজী নিজের মায়ের কথা শুরু করলেন । কিন্তু সামলাতে পারলেন না । প্রায় ৩ মিনিট তাঁর বাকরুদ্ধ ছিল । তারপর কান্নাভেজা গলায় বললেন যে সন্তানদের মানুষ করার জন্য তাঁর মা প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাসনমাজার ( বর্তনসাফ ) কাজও করেছেন । আর তিনি চা বিক্রি করেছেন । তখন উপস্থিত এক হাজার দর্শক অনেক কষ্টে নিজেদের সামলাচ্ছেন ।
এখানে আমি পাঠকের কাছে অনুমতি নিচ্ছি এই ঘটনায় আমার অনুভূতি ও উপলব্ধির কথা তুলে ধরতে ।
মােদীজীর এই আবেগ সামলাতে না পারা , ভেঙে পড়া — এগুলাে তাঁর ছােটবেলায় মায়ের কষ্টের কথা ভেবে নয় । মায়ের কষ্টের কথা তাে তাঁর সবসময় মনে থাকে । অনেক জায়গায় বলেছেনও সেই কথা । তাই তাঁর মত ইস্পাত-নার্ভের মানুষের তাে এতে ভেঙে পড়ার কথা নয় । তাহলে কেন পড়লেন ? আমার অনুভূতি থেকে পাওয়া উত্তর অন্যরকম । যে মা তাঁর সন্তানকে মানুষ করার জন্য এত কষ্ট করেছেন , সেই সন্তান আজকে বিশ্বসভায় শ্রেষ্ঠ আসন পেয়েছে , ভারতগৌরব হয়েছে , সুখসুবিধা প্রাপ্তির চূড়ায় পৌঁছেছে , কিন্তু সেখানে পৌছেও তার দুঃখী মা-কে এই বৃদ্ধ বয়সেও একটু সুখ দিতে পারছেন না , একটু সম্মানের ব্যবস্থা করে দিতে পারছেন না , দিল্লীর প্রধানমন্ত্রী আবাসে নিয়ে এসে রাখতে পারছেন না — এমনই কঠোর সাধনায় রত তিনি । এটাই যে তিনি ছােটবেলা থেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শাখায় প্রতিদিন প্রার্থনা উচ্চারণ করতে গিয়ে সংকল্প করেছেন— “ যৎ কন্টকাকীর্ণ মার্গং স্বয়ং স্বীকৃতং নঃ ” ( নিজেই বেছে নেওয়া এই কন্টকময় রাস্তা ) । বংশবাদ , স্বজনপােষণ , চাটুকারপ্রিয়তা এবং এসব থেকে জন্ম নেওয়া ভয়ঙ্কর দুর্নীতি ও নীতিতে আপােষ ( compromise in policy making including defence policy ) ভারতমাতার শরীরকে জীর্ণ করে দিয়েছে , রুগ্ন করে দিয়েছে । ফলে তার সন্তানরাও হচ্ছে রুগ্ন , দুর্বল ( শুধু শারীরিকভাবে নয় , চরিত্র , মানসিকতা ও আত্মবিশ্বাসে ) । সেই ভারতমাকে সুস্থ সবল করতে হলে যে তার সাধক পুত্রকে অনেক কষ্ট করতে হবে , অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে , কঠোর তপস্যা করতে হবে । সেই তপস্যারই তাে অঙ্গ নিজের জন্মদাত্রী মা’কে কষ্ট দেওয়া , কষ্ট দিয়ে নিজে কষ্ট পাওয়া ।
এ কষ্ট কি কাউকে বােঝানাে যাবে ? বুকে মােচড় দেওয়া এই কষ্ট , দেশমাতৃকার জন্য জন্মদাত্রী মা’কে কষ্ট দেওয়ার এই কষ্ট — এতেই মােদীজী সেদিন জুকেরবার্গের সামনে ভেঙে পড়েছিলেন । জড়বাদী আমেরিকায় মা – বাবার সঙ্গে বড় হয়ে যাওয়া সন্তানের সম্পর্ক অনেক অনেক অনেক কম । তাও সেখানে জুকেরবার্গের মা – বাবা এসেছেন কৃতী সন্তানের সাফল্যকে দেখতে ( কে জানে মােদীজীই তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কিনা ? ) । অথচ দেশগৌরব মােদীজী তাঁর মা’কে কোথাও নিয়ে যাচ্ছেন না , সম্মানের ভাগীদার করছেন না — এ কি যােগ নয় ? সাধনা নয় ? তপস্যা নয় ? এর থেকে বড় তপস্যা কঠিন তপস্যা ক’জন সাধু সন্ন্যাসী করেন ? করলে হিন্দু ধর্মের হিন্দু সমাজের হিন্দু দেশের আজ এই হাল হত না ।
মােদীজী ও তাঁর মায়ের কথা লিখতে গিয়ে আমিও কি কিছুটা আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম ? কে জানে । কিন্তু ২৭ তারিখ বিকালের কথা যে না লিখলেই নয় । ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের বে’এরিয়া ( Bay Area ) সান জোসে শহরে SAP সেন্টার স্টেডিয়ামের বাইরে ও ভিতরে সে যে এক ভারত দর্শন ! এ ভারত বহির্ভারত , কৃতী ভারত , মায়ের কোল থেকে দূরে থাকা ভারত । চোখ ভরে গেল , প্রাণ ভরে গেল , মন ভরে গেল ।
ফেসবুক থেকে ফিরে এসেছি জয়দীপের বাড়িতে । দুপুর থেকেই সেখানে সাজ সাজ রব । ভাত খাওয়ার আগেই জয়দীপের স্ত্রী মাম্পি শাড়ি পড়ে নিয়েছে । চার বছরের ছােট মেয়েকে ডে-কেয়ার সেন্টারে রেখে আসতে হবে । সেখানে যুধাজিৎ , অনির্বাণ ও শান্তনুর বাচ্চারাও থাকবে । প্রতি বাচ্চা ১০০ ডলার । ৬-৭ ঘণ্টা বাচ্চারা স্টেডিয়ামে কাটাতে পারবে । তাছাড়া আমাদের বঙ্গসন্তানেরা তাে শুধু মােদীজীকে দেখতে ও শুনতে যাচ্ছে না ! আরও অনেক কিছু ব্যাপার আছে যে ! গােটা ভারতের মিডিয়া থাকবে । তারা তাে বেশিরভাগই সেকুলার , হিন্দুবিরােধী । গত মে মাসে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ারে মােদীজীর ঐতিহাসিক কার্যক্রমকে NDTV- র বদমায়েস সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাই শুধু গুজরাতিদের অনুষ্ঠান বলে দেখানাের চেষ্টা করেছিল । কিন্তু মােদী সমর্থকরা তাকে এমন ঘষে দিয়েছিল যে এবার আর সে আসেনি । ক্যালিফোর্নিয়ার ভারতীয় যুবকরা তার জন্যবিশেষভাবে অপেক্ষা করছিল । তারা হতাশ হয়েছে । কিন্তু ভারতের মিডিয়াকুলে সেকু-মাকুর তাে অভাব নেই । বিগত ১২ বছর ধরে তারাই তাে মােদীজীকে নরখাদক রাক্ষস রূপে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিল । সেই মােদীজীকে ২০১৪ – র নির্বাচনে ভারতবাসী মাথায় তুলে নিলেও এদের লজ্জা নেই । এরা দুকান কাটা । তাই তাদের সামনে দেখাতে হবে যে মােদীজী সারা ভারতের প্রিয় , বাংলা-বাঙালিরও প্রিয় । তাই বাঙালি সাজে সেজে , আমাদের যুবক বন্ধুরা জোড়ায় জোড়ায় রেডি । হাতে ‘ মােদীজী স্বাগতম্ব্যানার নিয়ে দাপিয়ে বেড়াবে । ঢাকও রেডি । দুনিয়াকে দেখাতে হবে মােদীজী বাঙালিরও প্রিয় ।
ঠিক সেইরকমই হল । স্টেডিয়ামে মােদীজী আসবেন সন্ধ্যা ৭ টায় । দুপুর ২ টা থেকেই স্টেডিয়ামের বাইরে জমায়েত শুরু হয়ে গেছে । সব বাচ্চাদেরকে ডে-কেয়ার সেন্টারে জমা করে আমরা সাড়ে তিনটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম । স্টেডিয়ামের পাশে একটা পার্কে মিডিয়া সেন্টার হয়েছে । সেখানে বিরাট পর্দা লাগানাে আছে । যারা স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারবে না , তারা ওখানে পর্দায় দেখতে পাবে ।
এদিকে পার্কে মিডিয়া সেন্টারের সামনে কিছু খালিস্তানপন্থী শিখ জড়াে হয়েছে । তাদের হাতে মােদী বিরােধী স্লোগানের ব্যানার । পুলিশ মাঝখানে ব্যারিকেড করেছে । অন্যদিকে বিপুল সংখ্যায় মােদী সমর্থক । অনেক রাজ্যই ( ভারতের ) তাদের নিজস্ব পােষাক পড়ে এসেছে । হাতে রংবেরংয়ের ব্যানার । তবে সব থেকে বেশি দৃষ্টি কেড়েছে মারাঠিরা । ছেলে ও মেয়ে সকলের মাথায় গেরুয়া পতাকা । তাদের হাতেও ঢাক । তবে একটু অন্যরকমের । সাদা পােষাক , গেরুয়া পাগড়ি , গেরুয়া কোমরবন্ধনী । হাতে ঢাক গুলাে নিয়ে যে ভঙ্গিতে বাজাচ্ছিল — মনে হচ্ছিল যেন শিবাজীর সেনাবাহিনীর বাদ্যদল । আর মেয়েদের হাতে লেজিম । তিন লাইনে দাঁড়িয়ে নেচে নেয়ে অষ্টতাল বাজাচ্ছিল । আর এস এস থেকে এগুলাে আমার জানা । আরও কত রাজ্যের কত দল । আমাদের বাঙালি বীররা কম যায় না । ব্যানার ও ঢাক তাে আছেই । একটা হ্যান্ডমাইকও জোগাড় করেছে । হঠাৎ যুধাজিৎ স্লোগান দেওয়া শুরু করল — ভালােবাসি ভালােবাসি , মােদীজীকে ভালােবাসি । রহস্যটা হল এই যে সারা ভারতের অ-বাংলাভাষী মানুষেরা কমপক্ষে দুটো বাংলা কথা জানে । ( ১ ) আমি তােমাকে ভালােবাসি , ( ২ ) রসগােল্লা । বাঙালির ও-কারাত্মক গােল গােল উচ্চারণের সঙ্গে ভারতবাসী পরিচিত । তপন আমাদের উচ্চারণে তপােন হয়ে যায় । তাই ‘মােদীজীকে ভালােবাসি ‘ স্লোগানে সবাই বুঝতে পারবে যে এরা বাঙালি । বাঙালিও মােদীভক্ত , মােদীবিশ্বাসী । দুনিয়াকে এই বার্তা দিতে আমাদের ছেলেদের ও তাদের বৌদের তৎপরতার কোন অভাব ছিল না । Times Now লাইভ দেখাল ।
আমেরিকার সিলিকন ভ্যালিতে ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোসে‘র ময়দানে সেদিন তৈরি হয়েছিল এক ক্ষুদ্র ভারত । সেই উৎসাহ , উদ্দীপনা , উৎসবের মেজাজ , তারই মধ্যে সংকল্পের চিহ্ন — এসব দেখে আমার একটাই কথা শুধু মনে আসছিল । এটা ভারত উৎসব । আমেরিকায় ভারত উৎসব । বহির্ভারতে ভারত উৎসব । আর বারবার মনে হচ্ছিল — একটা মাত্র মানুষকে ঘিরে এই উৎসব , এই উচ্ছাস , এই উদ্দীপনা । ছােটোবেলা থেকে সযত্নে লালন করা একটা বিশ্বাস আমার অনেক আগেই টলে গিয়েছে । ব্যক্তি নয় , সংগঠন বড় । নাঃ , মােদীজী একা ( অন্যের দ্বিমত থাকতে পারে ) বহির্ভারতকে যেভাবে জাগিয়েছেন তাতে আর ব্যক্তিকে ছােট করে দেখা যায় না ।
যাক , বিকালের অনুষ্ঠানের ছিল তিনটে পর্যায় । প্রথম পর্যায় — ওই যে বললাম , স্টেডিয়ামের বাইরে ভারত উৎসব । দ্বিতীয় পর্যায় স্টেডিয়ামের ভিতরে প্রায় দেড়ঘণ্টার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । তৃতীয় পর্যায় মােদীজীকে সম্বর্ধনা ও তাঁর ভাষণ ।
দ্বিতীয় পর্যায়ের কথাও না বললেই নয় । বিশাল লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সিকিউরিটি চেক্ পার করে স্টেডিয়ামে ঢুকলাম । আমার কাছে সাধারণ পাস ও ভিআইপি পাস দুটোই ছিল । কয়েকজন হােমড়া চোমড়ারা আমাকে ভিআইপি ব্লকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন । কিন্তু , আমি বাঙালি দলের সঙ্গ ছাড়লাম না । আমার এই বাঙালিপ্রীতি হয়তাে তাদের ভালাে লাগেনি । কিন্তু পরে দেখলাম ভিআইপি ব্লকে না গিয়ে ভালােই করেছি । ১৮ হাজার আসনের এই বিশাল ইন্ডাের স্টেডিয়ামের একদম নীচে তাে মঞ্চ হয়েছে । তার চারিদিকে মাটিতে চেয়ারে ভিআইপি – রা । আর আমরা উঁচু গ্যালারিতে । উঁচুতে বসায় গােটা স্টেডিয়ামের চেহারাটা একসঙ্গে দেখা যাচ্ছিল ।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কোরিওগ্রাফিতে ৫-৬টা নৃত্য । সবগুলােই ভারতীয় । গরবা বা ভাংড়া ছিল না । তারপর কৈলাস খেরের গান । এর মধ্যে তিনটি নাচ ( গ্রুপ ) আমার এত ভালাে লাগল , মুগ্ধ হয়ে গেলাম । ভারতে এত ভাল কোরিওগ্রাফি দেখেছি বলে মনে পড়ল না । কেবল মনে হতে লাগল , যদি কোনদিন ভারত ধ্বংস হয়ে যায় , যদি কোনদিন গান্ধার – সিন্ধের মত ভারতেরও সভ্যতা হারিয়ে যায় , তবু আমাদের শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পদ এই আমেরিকায় বেঁচে থাকবে । আমাদের পূর্বপুরুষদের হাজার হাজার বছরের শিল্পসাধনার সৃষ্ট সম্পদ থেকে মানবজাতি বঞ্চিত হবে না ।
এরপর তৃতীয় পর্যায় । বিপুল করতালি ও ১৮ হাজার দর্শকের বাঁধভাঙা উচ্ছাসের মধ্য দিয়ে মােদীজী মঞ্চে আসার আগেই একে একে মঞ্চে আসতে লাগলেন ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য থেকে নির্বাচিত আমেরিকার পার্লামেন্টের সদস্যরা । এঁদেরকে ওখানে বলে কংগ্রেসম্যান অথবা সেনেটর ( সিনেট সদস্য ) । এঁদের মধ্যে ছিলেন আমেরিকার রাজনীতিতে প্রচণ্ড প্রভাবশালী ন্যান্সি পেলােসী এবং খ্রীষ্টান থেকে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করা তুলসী গাবার্ড । বাকিদের নাম মনে নেই । ১১ জন সেনেটর মঞ্চে লাইন করে দাঁড়ালেন । তারপর ঢুকলেন মােদীজী । উচ্ছাস বাঁধ ভাঙল । বিশ্বের বৃহত্তম শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১১ জন এম.পি. আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে সম্বর্ধনা জানাতে স্টেডিয়ামে উপস্থিত দেখে বহিভারতবাসীর বুকের ছাতি যেন ছাপান্ন ইঞ্চি হয়ে গেল ।
সম্বর্ধনার পর এম.পি.রা মঞ্চ থেকে নীচে নেমে গিয়ে প্রথম সারিতে বসলেন । তারপর শুরু হল মােদী ম্যাজিক । ১৮ হাজার শ্রোতাকে যেন মােদীজী তাঁর মনের তারের সঙ্গে বেঁধে নিলেন । বললেন , সিলিকন ভ্যালীর ভারতীয় যুবক যুবতীরা শুধু আঙুলের খেলায় গােটা বিশ্বে ভারতের স্থান অনেক উঁচুতে তুলে ধরেছেন । একে তিনি ‘ ব্রেন ড্রেন ’ বলে মনে করেন না । তিনি একে ‘ ব্রেন গেন ’ ( Brain gain ) বলে মনে করেন । তিনি তাঁর বিশ্বাস প্রকাশ করলেন যে ভারতমাতার এই কৃতীসন্তানেরা প্রয়ােজন পড়লেই ফিরে গিয়ে দেশমাতৃকার সেবা করবে । মােদীজী দর্শকদের কাছ থেকে একটা সার্টিফিকেট চাইলেন । বললেন , ভারতে তত শত কোটি , হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির কথা শুনতে সবাই অভ্যস্ত ছিল । কিন্তু গত ১৬ মাসে তার সরকারের কোন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনরকম আর্থিক দুর্নীতির অভিযােগ উঠেছেকিনা ? সমস্ত দর্শক একবাক্যে উত্তর দিল — না , ওঠেনি । মােদীজীর বক্তৃতার সবটা তুলে ধরার স্থান এটা নয় । কিন্তু ওই SAP স্টেডিয়ামে সেদিনের সভায় আমার একটা পর্যবেক্ষণের কথা বলে শেষ করব ।
বিরাট ইন্ডাের স্টেডিয়ামে একেবারে নীচে মঞ্চ । আমি অনেক উপরে গ্যালারিতে । মঞ্চের ঠিক উপরে স্টেডিয়ামের ছাদ থেকে ঝােলানো বিশাল বক্স-পর্দা । একটা বিশাল চারকোণা বক্সের চারদিকে চারটেপর্দা যাতে গােল স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসা দর্শক সব জায়গা থেকেই দেখতে পায় । মঞ্চের ছবি সেই পর্দায় বিরাট আকারে ফুটে উঠছিল । মােদীজীর বক্তৃতার এক একটা বাক্যের পর যখন গ্যালারিতে করতালির ঝড় উঠছিল , তখন মাঝে মাঝে ক্যামেরা ওই নীচে বসা এম.পি. দের মুখে ফোকাস ছিল । সেই ছবি পর্দায় বড় করে ফুটে উঠছিল । স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম যে , তাদের মুখের মানচিত্রগুলাে যেন বেঁকেচুরে যাচ্ছিল । সেই মুখে খুশী নেই , আবেগ নেই , প্রশংসা নেই । আছে এক বিস্ময় । আর তার সঙ্গে আরও কিছু যা আমি বর্ণনা করতে পারব না । তাঁদের ওই বিস্মিত ও বিকৃত মুখভঙ্গি দেখে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল যে এরা তাঁরা ভয় পাচ্ছেন । অথচ তাঁরা যে ভয় পেতে পারেন , নিজেরাই বিশ্বাস করতে পারছেন না । কিসের ভয় ? বিশ্ব রণাঙ্গনে এক শক্ত প্রতিযােগী এসে যাওয়ার ভয় । সােভিয়েতের পতনের পর দ্বিমেরু ( Bi – polar ) বিশ্ব একমেরু বিশ্বে পরিণত হয়েছিল । আমেরিকাই ছিল সেই মেরু । তারপর চীনের উত্থান আমেরিকাকে কিছুটা ভাবিয়ে তুলেছিল । কিন্তু চীনও পিছিয়ে পড়ছে । আমেরিকার সামনে কোন প্রতিযােগী , কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না । মােদীজী তাদের সেই নিশ্চিন্ততায় । আঘাত হেনেছেন । ভারতীয়দের মেধা , দক্ষতা , শৌর্য , বীর্য তারা জানে । কিন্তু এদের আত্মবিশ্বাস নেই । তাই তারা নিজের দেশের উন্নতি করতে পারে না । প্রতিভার পরিচয় দিতে পারে না । আড়াইশ বছর ধরে ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদ ও মেধা লুট করেই তাে ইউরােপ আমেরিকা উন্নত হয়েছে । কিন্তু এই নেতা ( মােদী ) যেভাবে তাঁর দেশের মানুষকে , প্রতিভাবান যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করছেন , উদ্দীপিত করছেন — তাতে ভারত আবার তার আত্মবিশ্বাসকে ফিরে পাচ্ছে । এই ভারতই তাে একসময় বিশ্বগুরু ছিল।সবথেকে সমৃদ্ধ দেশ ছিল । হাজার বছরের দাসত্ব তার আত্মবিশ্বাসকে নষ্ট করে দিয়ে এক হীনমন্য জাতিতে পরিণত করে দিয়েছিল । সেই জাতি যদি আবার তার হীনমন্যতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে ওঠে , তাহলে আমেরিকার দাদাগিরির আসনটা টলমল করে উঠবে — এই এক অবিশ্বাস্য আশঙ্কায় ওই কংগ্রেসম্যানদের মুখের ভূগােল বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল । আমার খুব মজা লাগছিল ।
আমেরিকায় যা দেখে এলাম , যা শুনে এলাম , যা বুঝে এলাম , তা হল এই যে ভারত আবার জাগছে । তবে সে জাগরণ শুরু হয়েছে বহির্ভারতে । দেখা যাক সে জাগরণের ঢেউ ভারতে কবে পৌঁছায় ।
২৭ সেপ্টেম্বর রাতটা যেন একটা আবেশে কাটল । ২৮ তারিখ সকালে সান ফ্রান্সিসকো বিমানবন্দর থেকে বিমান ধরে আবুধাবিতে বিমান পাল্টে ২৯ তারিখ রাত্রে কলকাতা । ঘরের ছেলে ঘরে ।
সংকলন শুভঙ্কর নাগ
সংগৃহীত স্বদেশ সংহতি সংবাদ পূজা সংখ্যা ২০১৫
