লেখক পথপ্রদর্শক মাননীয় তপন ঘোষ আমি একজন বিরাট পণ্ডিত নই , তাত্ত্বিক নই , দার্শনিক নই , গবেষকও নই । নিজের পরিচয় বড়জোর একজন হিন্দু কর্মী বা হিন্দু অ্যাকটিভিস্ট হিসাবে দিতে পারি । ছােটবেলা থেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে এসে দেশভক্তি ও হিন্দু স্বাভিমান তৈরি হয়েছে । তাই হিন্দুর অপমান ও পরাজয় সহ্য হয় না । তাই হিন্দুর অস্তিত্ব ও সম্মান রক্ষার কাজে নেমেছি । কিন্তু এই কাজে নেমে প্রতিপক্ষের শক্তির মােকাবিলা করতে গিয়ে নিজেদের ঘাটতি , দুর্বলতা ও ত্রুটিগুলি বড় বেশী করে নজরে আসছে । সেগুলিকে বলতে গেলেই নিজেদের সমালােচনা হয়ে যায় , যা হয়ত অনেকেই পছন্দ করবেন না । কিন্তু এই ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলিকে নিয়ে যুদ্ধে জেতাই বা কি করে যাবে ? যাবে না । সুতরাং , এই ত্রুটিগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে ও দূর করতে হবে । এ কাজ কার ? এ কাজ ধর্মসংস্কারকের বা সমাজ সংস্কারকের । তাঁদেরকেই কি আজকের পরিভাষায় বুদ্ধিজীবি বলে ? সঠিক বলা কঠিন । কিন্তু যদি তাই হয় , তাহলে এই বুদ্ধিজীবিদের ধর্ম বা সমাজ সংস্কারের কোন অধিকার নেই । কারণ , ধর্মের সঙ্গে এতটুকু একাত্মতা অথবা সমাজের প্রতি একটুও আত্মীয়তা এদের আচরণে পাওয়া যায় না । সব নামকরা তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিজীবিরা মালের বােতলকে তাঁদের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের অঙ্গ বলে মনে করেন । টাকা , পদ ও পুরস্কারের বিনিময়ে তাঁদের বুদ্ধি বিক্রি করেন । আর সব থেকে বড় কথা , ভারত – ভারতবাসী ও হিন্দু ধর্মকে এঁরা শ্রদ্ধা ও ভালবাসার চোখে দেখেন না । তাই ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের ভূমিকা বা অধিকার এদের নেই । তবে একটা ছােট্ট আশার আলাে দেখা যাচ্ছে । সুনীল গাঙ্গুলী নামে একজন ঘৃণ্য ব্যক্তিকে বিরাট প্রচার সংস্থা আনন্দবাজার কোম্পানী যেভাবে একজন অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবি বলে প্রচার করেছে , তাতে বহু প্রকৃত চিন্তাবিদই আজকে নিজের গায়ে বুদ্ধিজীবি ছাপ নিতে রাজী নন । আনন্দবাজার হাউসের কীর্তির ফলে বুদ্ধিজীবি শব্দটা তার মর্যাদা হারিয়েছে । সুনীল – শক্তি – নীরেন যদি লিডিং বুদ্ধিজীবি হয় , আর আইডেন্টিফায়েড উইথ মালের বােতল এন্ড ডট্ ডট্ ডট্ ডট্ , তাহলে অনেক শিক্ষিত সচ্চরিত্র ব্যক্তিই নিজেকে বুদ্ধিজীবি বলে পরিচয় দিতে চাইবেন না । তাহলে ধর্ম বা সমাজ সংস্কার করবে কে ? দুটি নাম মনে আসে । বিভিন্ন ধর্মগুরু ও পুরােহিত । অত্যন্ত দুঃখের কথা যে , বিগত প্রায় ১০০ বছরে হিন্দুদের অধিকাংশ ধর্মগুরু বা পন্থগুরুরা নিজেদেরকে গােষ্ঠী গুরুতে পরিণত করে ফেলেছেন । তাঁরা শুধু নিজ নিজ মঠের উন্নতি ও সম্প্রদায়ের অনুগামী সংখ্যার বৃদ্ধিতে এত বেশী লিপ্ত হয়ে পড়েছেন যে পুরাে সমাজের নেতৃত্ব বা পথপ্রদর্শন করার যােগ্যতা তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন । এঁরা ভুলে গিয়েছেন যে , ব্যাস , বশিষ্ঠ , বিশ্বামিত্র , ঋষ্যশৃঙ্গ , দুর্বাসা , কাশ্যপ , কপিলমুনিরা নিজেদের মঠও তৈরি করেননি , গােষ্ঠীও তৈরি করেননি , সম্প্রদায়ও তৈরি করেন নি । রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন তৈরির সময় স্বামী বিবেকানন্দ অত্যন্ত স্পষ্টশব্দে বাংলা ভাষায় বলে গিয়েছেন , শ্রীরামকৃষ্ণকে যারা গুরু বলে মানেন , সেই শ্রীরামকৃষ্ণ অনুগামীরা যেন হিন্দুসমাজের মধ্যে আরও একটি নতুন সম্প্রদায় সৃষ্টি না করেন । বিবেকানন্দের বিশাল রচনাবলী ও ভাষণগুলি পড়লে দেখা যায় যে , তাঁর অতি গভীর গুরুভক্তি থাকলেও সর্বত্র তিনি গুরুর নাম প্রচার করেননি । তার শতকরা আশিভাগ ভাষণেই গুরুর উল্লেখ নেই । তিনি গােষ্ঠীর নেতা হতে চাননি । তাই সমাজের নেতা হতে পেরেছেন । আর থাকলেন পুরােহিত । পুরােহিতকে আজও সমাজ শ্রদ্ধা করে , সম্মান দেয় । কিন্তু বাস্তবকে তাে মানতেই হবে । এক ব্রাহ্মণের যদি চারটি পুত্র হয় ( আগে তাে হতই ) , সেই পরিবারে যদি পৌরহিত্য করার পরম্পরা থাকে , তাহলে সেইব্রাহ্মণ পিতা তার সব থেকে কম মেধাবী ও কম বুদ্ধিমান পুত্রটিকেই পৌরহিত্য-র কাজে লাগাবেন । বাকী তিনজন হবে ব্যাঙ্কের অফিসার , ডাক্তার ও শিক্ষক । সুতরাং সেই পুরােহিত পুত্রটি কোনরকমে কিছু শ্লোক মুখস্থ করে পূজা-যজ্ঞ-বিবাহ-শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানের নিয়মকানুনগুলি অনুসরণ করে কাজ সারবে । ধর্মের সংস্কার বা সমাজের পথ প্রদর্শন — এদের কাছে আশা করা যায় না । এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি যে পৌরহিত্য বৃত্তির সবথেকে বেশী অবমূল্যায়ন হয়েছে উত্তর ভারতে হিন্দিভাষী প্রদেশগুলিতে পাঞ্জাব সহ । অত্যন্ত লজ্জার কথা যে আলু পটল মাছ সবজির মত পুরােহিতদেরও (হিন্দিতে বলে পণ্ডিত বা পণ্ডিতজী) বাজার বসে আমাদের কলকাতায় বড়বাজারে রােজ সন্ধ্যায় । এই লজ্জাকর অবস্থা থেকে মুক্তির একটাই মাত্র উপায় আছে । তা হল পৌরহিত্যে সকল বর্ণের ও সকল জাতির অধিকার দেওয়া । আচণ্ডাল-ব্রাহ্মণ গােটা সমাজের জন্য এই বৃত্তি উন্মুক্ত করলে তবেই সব জাতির মেধাবী ও প্রতিভাবান যুবক-যুবতীরা এই কাজে আসবেন । এই বিষয়ে একটা ছােট্ট সাবধানবাণী মনে রাখা দরকার । আমার এই প্রস্তাবের বিরােধিতা ব্রাহ্মণরা যতটা করবে , সমাজের অব্রাহ্মণরা আমার এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে তার থেকেও বেশি অনিচ্ছা প্রকাশ করবে । ব্রাহ্মণ দিয়ে বাড়ির ও পাড়ার পুজো না করালে তাদের মন খুঁত খুঁত করবে । এটারই নাম বিজ্ঞানের ভাষায় স্থিতিজাঢ্য বা জড়তা । অর্থাৎ পরিবর্তনে অনিচ্ছা । এই জড়তাকেই আমাদের ধর্মে তমােগুণ বলা হয়েছে । বিবেকানন্দ বলেছেন যে তমােগুণে গােটা দেশটা ছেয়ে গেছে । এটা ভাঙতে গােটা দেশে রজোগুণের বন্যা বইয়ে দিতে হবে । অত্যন্ত দুঃখের কথা যে আজকাল অনেক গুরু ও কথাকার হয়েছেন যাঁরা ভক্তমণ্ডলীকে কেবলই সত্ত্বগুণের অধিকারী হতে বলেন , সাত্ত্বিক হতে বলেন । এঁরা ভ্রান্ত । এঁরা সম্পূর্ণ ভুল , অবৈজ্ঞানিক ও অশাস্ত্রীয় কথা বলেন । কারণ , তমােগুণে আচ্ছন্ন মানুষ এক লাফে সাত্ত্বিক হতে পারে না । তমাে থেকে রজোগুণে গিয়ে তবে সত্ত্বগুণে যাওয়া যায় । ধাপ ডিঙানাে যায় না । ক্ষত্রিয় বিশ্বামিত্র রাজা বিশ্বামিত্র । অর্থাৎ রজোগুণী । তাকে সত্ত্বগুণী ব্রাহ্মণ হতে কত হাজার বছর তপস্যা করতে হয়েছিল। তাহলে তমােগুণীকে সাত্ত্বিক হতে হলে কতটা কষ্ট করতে হবে ? কোটি কোটি মানুষ কি তা করতে পারবে ? সুতরাং , গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে আজকের গুরুবাহিনী ভক্তদেরকে সাত্ত্বিক হওয়ার উপদেশ দিয়ে তাদেরকে ঐ তমােগুণের মধ্যেই ফেলে রাখছেন । মনে রাখা দরকার যে সত্ত্বগুণ ও তমােগুণের বাহ্যিক লক্ষণ অনেক সময়ই এক । তমােগুণী গালে একটা চড় খেলে ভীরুতা , কাপুরুষতা ও জড়তা ( নিষ্ক্রিয়তা ) বশতঃ সে পাল্টা চড় মারতে পারবে না । আবার সত্ত্বগুণী গালে একটা চড় খেলে হয়ত অত্যাচারীকে ক্ষমা করে দেবে । দুটোই বাইরে থেকে একইরকম দেখাবে । কিন্তু দুটো এক নয় । তাই এই গুরুরা সমাজকে সত্ত্বগুণী হতে বলে ভণ্ডামি শেখাচ্ছেন । সত্ত্বগুণের নামে সমাজে জড়তা ও কাপুরুষতা বিস্তার করছেন । এই তমােগুণ আবার আমাদের দেশ ও জাতিকে পরাধীন করবে । আমাদের দেশের বর্তমানের এই গুরুবাহিনীর কথা আরও আলােচনা করতেই হবে । কারণ , এঁদের প্রভাব প্রতিপত্তি এখন যথেষ্ট । এবং এঁদের চলা , বলা , উপদেশ ও আচরণগুলােই হিন্দুধর্মের পরিচায়করূপে সমাজে খ্যাতি পাচ্ছে । তাই এগুলাের স্ক্যান করা দরকার যে এগুলাে আমাদের হিন্দু ধর্মের সঠিক পরিচায়ক কিনা । আগেই বলেছি , এই গুরুরা শুধু সত্ত্বগুণের গুণগান গেয়ে সবাইকে সাত্ত্বিক হওয়ার উপদেশ দিয়ে অশাস্ত্রীয় , অবৈজ্ঞানিক ও অন্যায় কাজ করছেন । রজোগুণের মহত্ব ও প্রয়ােজনীয়তাকে অস্বীকার করছেন । রজোগুণ না থাকলে রাজ্য কী করে চালাবে ? সত্ত্বগুণ দিয়েই যদি সব হত , তাহলে দশরথ , রামকে রাজা হতে হত না , বশিষ্ট বিশ্বামিত্ররাই রাজা হতেন । আর উপযুক্ত রাজা ( শাসক ) না থাকলে প্রজা নষ্ট , রাজ্য ছারখার । সুতরাং , রজোগুণ একান্ত প্রয়ােজনীয় । তাছাড়া , এটা তাে প্রকৃতিরই সৃষ্টি , অর্থাৎ স্বাভাবিক । এটাকে অস্বীকার করা অবৈজ্ঞানিক । আমাদের মূল শাস্ত্রে রজোগুণকে কোনভাবে তাচ্ছিল্য করা হয়নি । আজকের গুরুরা করছেন । কোন্ শাস্ত্রের শিক্ষায় কে জানে । এরপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলা দরকার । আমাদের ওইসব গুরু , প্রবচনকার , কথাকাররা শিষ্য ভক্তদের শুধু ভক্তির কথা শেখান । কার প্রতি ভক্তি ? ভগবানে ভক্তি ও গুরুভক্তি । শুধু ভক্তি দিয়েই ভগবানকে পাওয়া যায় , আর ভবসাগর পার হওয়া যায়- কত ইনিয়ে বিনিয়ে শুধু এই কথাই বলেন । এটা কি আমাদের ধর্মের কথা বা শাস্ত্রের কথা ? না , আমাদের শাস্ত্রে জ্ঞান , ভক্তি ও কর্ম- তিনরকম মার্গ বা পথের কথা বলা আছে । যার যার প্রকৃতি , প্রবণতা ও রুচি অনুসারে এক একটা পথ গ্রহণ করবে এবং সেই পথে চলবে । খুব স্পষ্টভাবেই নচিকেতা ছিল জ্ঞানমার্গী , প্রহ্লাদ ও ধ্রুব ছিল ভক্তিমার্গী , অর্জুন , ভীম ও হনুমান ছিলেন কর্মমার্গী । বর্তমানে গুরুরা আর ব্যবসায়ীরা হনুমানজীর হাতেও জপের মালা ধরিয়ে বীর হনুমানকে কর্মহীন ভক্তে পরিণত করে ফেলেছেন । রামের পায়ের কাছে হনুমানজী হাত জোড় করে হাঁটু মুড়ে বসে আছেন — শুধু এই ছবি ক্যালেন্ডারে দেখা যায় । কিন্তু তিনি লঙ্কা পােড়াচ্ছেন , লাফিয়ে সাগর পার হচ্ছেন , গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে আসছেন আর গদাঘাতে ও আছাড় মেরে রাক্ষসদের মারছেন । এ ছবিগুলাে দেখা যায় না । কর্মমার্গী হনুমানকে বানিয়ে দিলেন ভক্তিমার্গী । আর একই সঙ্গে ভুলিয়ে দিলেন তাঁর শক্তির কথা । আমাদের এই গুরুদের শক্তি , সাহস ও কর্মোদ্যমে বড় অনীহা । শুধু ভক্তি আর অহিংসা এঁদের বড় প্রিয় । কারণ , ভক্তিতে ফায়দা বেশী , আর অহিংসায় ঝামেলা কম । অহিংসার কথায় পরে আসছি । মুসলিম শাসনের মধ্যকাল থেকে গােটা ভারতেই এই ভক্তির বাড়াবাড়ি শুরু হয়েছে । এর নাম দেওয়া হয়েছে ভক্তি আন্দোলন । এ সম্বন্ধে অনেক প্রশংসা ও গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে । কিন্তু একথা কেউ স্বীকার করছেন না যে বিধর্মী মুসলিম শাসনে সেই ভয়ংকর যবন অত্যাচারের মধ্যে আমাদের ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এই ভক্তি পথ নেওয়া শুরু হয়েছিল । কিন্তু এই ভক্তি লতায় পাতায় সমাজের বহু স্তরে এমনভাবে ঢুকে গিয়েছে যে জ্ঞান ও কর্মের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে । ফলে ভক্তি দিয়ে ধর্মটিকে ধরে রাখলেও সমাজ হয়ে গিয়েছে শক্তিহীন । ধর্মটাকেও বা ধরে রাখতে পেরেছে কই ? শ্রীচৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণবপন্থা বা নামধর্মের প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের থেকে পূর্ববঙ্গে বেশী ছিল । তাহলে সেখানে এত মুসলমান হল কেন ? এত মুসলমান হল বলেই তাে দেশটা ভাগ হল । শ্রীচৈতন্যদেব সম্বন্ধেও অনেক প্রশ্ন উঠছে । ক্ষমা , দীনতা ও অহিংসার পূজারী চৈতন্য ভক্তরা এইসব প্রশ্ন শুনে রে রে করে না উঠে প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলে ভাল হয় । যবন । শাসনের অত্যাচার ও নিষ্পেষণের মধ্যে বাঙালিকে রেখে দিয়ে তিনি বাংলা ছেড়ে চলে গেলেন কেন ? তিনি হিন্দুরাজ্য উড়িষ্যায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন । তাঁর মাত্র ৪৮ বছরের জীবনের দীর্ঘ ১৮ বছর তিনি উড়িষ্যায় কাটিয়েছেন । সেখানে রাজা প্রতাপরুদ্র তাঁর শিষ্যত্ব নিয়েছেন । কিন্তু তা সত্ত্বেও উড়িষ্যার মানুষ তাঁর তৃণাদপি সুনীচেন আর রাধাভাব আর হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ বলে । চোখের জল ফেলা আর নামধর্ম গ্রহণ করেনি । তারা জগন্নাথদেবের প্রতি অটুট ভক্তি বজায় রেখে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ করে নিজেদের কর্তব্য ধর্ম পালন করে গেছে । তাই তাদের রাজ্য সারা ভারতের যবন শাসনের মধ্যেও সব থেকে বেশীদিন নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখতে পেরেছিল । আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা- শ্রীচৈতন্যের বাংলায় আজ ২৩ কোটি মানুষের মধ্যে ( পঃবঙ্গ + বাংলাদেশ ) ১৬ কোটি অথাৎ ৭০ শতাংশ মুসলমান । আর উড়িষ্যায় ২ শতাংশ মুসলমান । রাধাভাব , ভক্তিবাদ আর নামধর্মের এই যদি পরিণাম হয় , তাহলে কি আর একবার ভেবে দেখা দরকার নয় ? আজকে ইউরােপ আমেরিকার লোক মহাপ্রভুর নাম নিচ্ছে । খুব আনন্দের কথা । কিন্তু তাঁরই জন্মস্থান নদীয়া জেলার মুসলমান ও তাঁর পর্বপুরুষের বাসস্থান শ্রীহট্টের ( সিলেট ) মুসলমানরা তাঁকে মহাপ্রভু বলে মনে করে , নাকি কাফের বলেই মনে করে । সুতরাং আমার স্পষ্ট মত ভক্তি একজন মানুষের জীবনে প্রধান মার্গ হতে পারে , কিন্তু একটা জাতির জীবনে হতে পারে না । সেখানে জ্ঞান , কর্ম ও ভক্তি- তিনটিরই সমান গুরুত্ব । এই তিনটে মিলে একটা সমাজে পূর্ণতা আসতে পারে । যে কোন একটা বা দুটো মিলেও আসবে । আমার স্পষ্ট মত ভক্তিবাদ ও ভক্তি আন্দোলন যবন শাসনে হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব রক্ষায় সাহায্য করেছে । তাই সেটা ছিল আপদ্ধর্ম । কিন্তু সেটাকেই স্থায়ী ধর্ম করায় বড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে । ভক্তি ঢেকে দিয়েছে শক্তিকে , সাহসকে আর কর্মোদ্যমকে । আজকের প্রয়ােজন ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা । নিষ্ঠা আর ভক্তির মধ্যে তফাৎ আছে । নিষ্ঠা মানুষকে আরও কর্মোদ্যমী করে তােলে , দায়িত্ব পালনে আরাে সক্রিয় করে তােলে , আর ভক্তি মানুষকে ভাগ্যবাদী ও পর নির্ভরশীল করে তােলে । ফলে তার সক্রিয়তা ও কর্মোদ্যম নষ্ট হয়ে যায় । এইবার আসা যাক বহু প্রচারিত অহিংসার কথা । অহিংসা পরমাে ধর্ম — আমাদের শাস্ত্রে কয়েক স্থানে একথা লেখা আছে । জৈন সম্প্রদায় এই অহিংসা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে । কিন্তু আমাদের ধর্মের প্রধান লক্ষণ কি এই অহিংসা ? , তা নয় । আমাদের শাস্ত্রে অতি স্পষ্ট করে ধর্মের দশটি লক্ষণের কথা বলা আছে ? ধৈৰ্য্য , ক্ষমা , সংযম , অস্তেয় বা অচৌৰ্য্য , শুচিতা বা পরিচ্ছন্নতা ( অন্তর ও বাহ্য ) , ইন্দ্রিয়দমন , ধী অর্থাৎ জ্ঞান বা প্রজ্ঞা , বিদ্যা , সত্য এবং অক্রোধ বা ক্রোধহীনতা । “ ধৃতি ক্ষমা দমস্তেয় শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ ধীর্বিদ্যা সত্যম্ অক্রোধ দশকং ধর্মলক্ষণম্ । ” এর মধ্যে অহিংসা কোথায় আছে ? সংযম ও ক্ষমার কথা অবশ্যই আছে । কিন্তু অহিংসা নেই ! বিশ্বামিত্র মুনি কিশাের রাম লক্ষ্মণকে তপােবনে নিয়ে গেলেন তাড়কা রাক্ষসী মারতে । এটা অহিংসা ? শিশু কৃষ্ণ পূতনা বধ করলেন অহিংসা দিয়ে ? অঘাসুর , বঘাসুর , কংস , জরাসন্ধ , শিশুপাল বধ , জরাসন্ধ বধের পদ্ধতি , নৃসিংহ অবতার দ্বারা হিরণকশিপু বধ- এগুলাে সব অহিংসার পরিচয় ? বৃত্তাসুর বধ , মহিষাসুর বধ , মহাদেবের আদেশে বীরভদ্র দ্বারা রাজা দক্ষ বধ , দক্ষযজ্ঞ লন্ডভন্ড করে দেওয়া— এগুলাে অহিংসা ? আমাদের ধর্মে ও শাস্ত্রে এরকম ঘটনা হাজার হাজার হাজার হাজার । সমস্ত দেবদেবীর হাতে অস্ত্র । এসব কি আমাদের ধর্ম নয় ? তাহলে অহিংসা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন ? এই অহিংসা অহিংসা করতে করতেই কি আমাদের হিন্দু জাতিটা কাপুরুষে পরিণত হয়নি ? একাদশ শতাব্দী থেকে ভয়ংকর যবন অত্যাচার ও নৃশংসতার ( Presecution ) হাত থেকে হিন্দু বা সনাতন ধর্মকে বাঁচাতে ভক্তির পথ নেওয়া শুরু হয়েছিল । তার তবু একটা যুক্তি পাওয়া যায় । কিন্তু মােক্ষ অনুসন্ধানের এত বাড়াবাড়ির কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না । কোথা থেকে এই বিকৃতি এল আমাদের সমাজে ? মানব জীবনের উদ্দেশ্য কী ? মােক্ষপ্রাপ্তি বা মুক্তিলাভ । কিসের মুক্তি ? আত্মার মুক্তি । কিভাবে হবে ? পুনর্জন্ম থেকে রেহাই পাওয়া । জন্মলাভ মানেই তাে দুঃখভােগ আর মােহ । তাই এর হাত থেকে মুক্তি পেতে হবে । তাই ধর্ম টর্ম যারা মানে , তারা সবাই ছুটছে মােক্ষলাভের জন্য । আসলে কেউই ছােটেনা । এ এক অদ্ভুত ভন্ডামি বা আত্মপ্রবঞ্চনা , যার পরিণাম অতি খারাপ । যদি সত্যিই মােক্ষ চাইত , তাহলে নাতি নাতনির উপর এত টান কেন ? টাকা পয়সার উপর এত মায়া কেন ? তাই মােক্ষের আকাঙ্খাটা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সত্য নয় । বহু জন্ম কর্মের পর যখন কর্মের বন্ধন কাটবে , তখন মােক্ষের আকাঙ্খা তৈরী হবে । এই কর্মের বন্ধন কাটবে কর্ম ত্যাগ করে নয় , নিষ্কাম কর্মের মধ্য দিয়ে । মানুষ নিষ্কাম অর্থাৎ কামনাহীন কখন হবে ? যখন মােহ কাটবে । কিসের প্রতি মােহ ? নিজের শরীরের প্রতি ও আপনজনের প্রতি । যখন আপনজন আর পরের মধ্যে ভেদ কমবে , তখনই কর্ম হবে মােহহীন আর নিষ্কাম । তার আগেই মােক্ষ মােক্ষ করলে কর্মটাই গুলিয়ে যায় । আর আমাদের সমাজের তাই গিয়েছে । একদিকে মুখে মােক্ষ মােক্ষ করছে , আর অন্যদিকে মােহের বশে যত অকর্ম আর কুকর্ম করছে । তাই দেখা যায় , যার মালা তিলক যত বড় , মুখে ঠাকুরের নাম যত বেশী , ব্যবসায় দুর্নীতি তার তত বেশী । একথা শুনে অনেকেরই খারাপ লাগবে , কিন্তু সমাজের সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা তাই । কিন্তু ধর্মের নাম নিয়ে , ধর্মের বাহ্যিক চিহ্নগুলি বেশী করে বহন করে এত অধর্ম যারা করছে , তারা কি নিজের বিবেকের কাছে কোন সাফাই দিচ্ছে না ? নিশ্চয় দিচ্ছে । সেই সাফাইটা হচ্ছে ধর্ম আর কর্মকে আলাদা রাখা । তারা ভাবে , ধর্মকরছি মােক্ষের জন্য , আর কর্ম করছি নেহাতেই সংসারের জন্য । দুটো পৃথক । তাই কর্মের দিকে যতই জাল – জুয়াচুরি করি কেন , যতই মানুষকে ঠকাই না কেন , তাতে আমার ধর্মের দিকটা ব্যাহত হবে না । মােক্ষ মােক্ষ করার এই হল চরম কুফল , যা আমাদের সমাজকে শেষ করে দিচ্ছে । সুতরাং যে গুরুরা অথবা ধর্মব্যবসায়ীরা অনধিকারীকে অর্থাৎ সময় আসার পূর্বেই শিষ্যকে মােক্ষের উপদেশ দেন , তাঁরা চরম ক্ষতি করছেন । তারা মানুষকে কর্তব্যচ্যুত করেছেন । ফলে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা ও অনাচার । সর্বসাধারণ মানুষের জন্য মােক্ষধর্ম জরুরী নয় । তার থেকে অনেক বেশী জরুরী কর্তব্যধর্ম । ( এ বিষয়টা আগে একটা লেখায় লিখেছিলাম । এখানে পুনরুক্তি করতে হচ্ছে । ) তাই সংসার ধর্ম , গার্হস্থ্য ধর্ম , রাজধর্ম , প্রজাধর্ম , ছাত্রধর্ম , পিতৃধর্ম , পুত্রধর্ম , পতিধর্ম , পত্নীধর্ম , যুগধর্ম , যৌবনধর্ম , ক্ষাত্রধর্ম , আপদ্ধর্ম — এই শব্দগুলি বহুল প্রচলিত এবং সহজবােধ্য । সাধারণ মানুষ সহজেই এগুলাের মানে বােঝে এবং ব্যবহার করে । এই প্রত্যেকটি শব্দেরই অর্থ – কর্তব্য , পৃথক পৃথক ভূমিকায় বা অবস্থানে । রাজার কর্তব্য রাজধর্ম , প্রজার কর্তব্য প্রজাধর্ম , ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য ক্ষাত্রধর্ম , ছাত্রের কর্তব্য ছাত্রধর্ম , যৌবনকালে যুবকের কর্তব্য যৌবনধর্ম , আপকালে কর্তব্য আপদ্ধর্ম । এই কর্তব্যগুলি কী কী — সেই শিক্ষাই সাধারণ মানুষের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা , সেটাই ধর্মশিক্ষা । সেই শিক্ষাদানে আমাদের ধর্মীয় নেতৃত্ব সম্পূর্ণ ব্যর্থ । তাঁরা এই কর্তব্যধর্মের শিক্ষা না দিয়ে মােক্ষধর্মের শিক্ষা দিয়ে সমাজকে বিপথে চালিত করেছেন । তাঁরা সমাজকে কর্তব্যচ্যুত করেছেন । এইবার আমি পা দেব এক অগ্নিকুণ্ডে । আমি উপরে যে অভিযােগ করলাম , সেই অভিযােগে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকেও আমি অভিযুক্ত করছি । তিনি গৃহস্থের জন্য বহু উপদেশ দিয়ে গিয়েছেন । কিন্তু তিনি নিজে কি গৃহী ? আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি গেরুয়া পরেন নি , সন্ন্যাস দীক্ষা নেননি এবং পত্নী তাঁর সঙ্গে ছিলেন । সুতরাং প্রথাগতভাবে তিনি সন্ন্যাসী নন , তিনি গৃহী । অথচ , একথা স্পষ্ট যে তিনি একজন পূর্ণ গৃহী নন । আর তাঁর ভক্তবৃন্দরা তাে তাকে সাধু বা সন্ন্যাসী বলেই মনে করে । সুতরাং , গৃহস্থের পূর্ণ জ্ঞান তাঁর ছিল কী ? ভক্তবৃন্দ , মাপকরবেন । আদি শঙ্করাচার্য্য , যিনি ৮ বছর বয়সে বেদ অধ্যয়ন সম্পূর্ণ করেছিলেন , ১৬ বছর বয়সে বেদের ভাষ্য লিখেছেন , তারও গৃহস্থের জ্ঞান অসম্পূর্ণ ছিল । মন্ডন মিশ্রের পত্নী উভয়ভারতী দেবীর প্রশ্নের উত্তর না দিতে পেরে কোন গৃহস্থ রাজার কায়াতে প্রবেশ করে তাকে সেই জ্ঞান নিয়ে আসতে হয়েছিল । আমাদের ব্যাস , বশিষ্ট , বিশ্বামিত্র , পরাশর , যাজ্ঞবল্ক্য — সকলেরই সেই জ্ঞান ছিল । কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণদেব ছিলেন সেই জ্ঞান থেকে বঞ্চিত । অথচ তিনি গৃহস্থদের উপদেশ দিচ্ছেন — কামিনী কাঞ্চন ত্যাগ কর , একটি দুটি সন্তান হওয়ার পর স্বামী স্ত্রী ভাইবােনের মত থাকবে । এ তাে চরম বিভ্রান্তি । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ১৫ টি সন্তান ছিল , বশিষ্ট অরুন্ধতীর ১০০ সন্তান ছিল । শ্রী কেশবচন্দ্র চক্রবর্তীর ১৫ টি সন্তান ছিল । কেশববাবু , আমাদের মাস্টারমশাই হাওড়া গার্লস কলেজের প্রিন্সিপ্যাল , তাঁর বাড়িতে ছােটবেলায় যেতাম । অবাক হয়ে দেখতাম , অতগুলি সন্তান , এক তরকারি ভাত , কিন্তু তাও সবসময় বাড়িতে একজন অতিরিক্ত ছাত্র থাকে — গরীব আত্মীয় অথবা অন্য কেউ । এই বশিষ্টদেব , মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ , কেশবচন্দ্র — এঁরা কি কর্ম ধার্মিক ছিলেন ? পাঠকগণ আমাকে মাপ করবেন , শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শতকরা ৯৯ ভাগ শিষ্যের থেকেও এঁরা অনেক বেশী ধার্মিক ছিলেন । শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ পালন করলে আমরা রবীন্দ্রনাথকেও পেতাম না , নেতাজীকেও পেতাম , আর দেবকীনন্দন শ্রীকৃষ্ণকেও পেতাম না । আরও বলি , স্বামী বিবেকানন্দের সুবিশাল রচনাবলী পড়ে দেখুন — স্বামীজি তার পরমরাধ্য গুরুর এই উপদেশ repeat করেন নি । কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করা কার কর্তব্য-গৃহীর সন্ন্যাসীর ? ভারতের মাটির নীচে সােনা নেই । তাও বহু যুগ ধরে ভারত স্বর্ণভাণ্ডার হয়ে আছে । আজও । ভারতের এই ঐশ্বৰ্য্য যুগে যুগে সারা বিশ্বের বণিককুলকে আকৃষ্ট করেছে এখানে । আজও করছে । আমাদের চাঁদ সদাগরেরা এদেশের উন্নতমানের পণ্য নিয়ে গিয়ে সারা বিশ্ব থেকে সােনা তুলে নিয়ে এসে এদেশকে স্বর্ণভাণ্ডার বানিয়েছিলেন । সে সােনা শুধু ঐ সদাগরদের ঘরেই থাকত না । ঐ উন্নতমানের পণ্য যারা তৈরী করতেন , অর্থাৎ কামার , কুমাের , তাঁতী , চাষী — তাদের ঘরেও ঐ সােনা পৌঁছাত ও জমত । তাই তাে এদেশকে ‘সােনে কী চিড়িয়া’ বলা হত । শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ মেনে এদেশে গৃহস্থরা কাঞ্চন ত্যাগ করলে কি এটা হত ? হত না । বরং তার বদলে গৃহস্থরা কর্তব্যচ্যুত হয়ে গরীব হত , আর দেশটা ভিখিরি হত । সুতরাং , কামিনী কাঞ্চন ত্যাগ করার উপদেশ গৃহীর জন্য নয় , সন্ন্যাসীর জন্য । কিন্তু রামকৃষ্ণ ভক্তদের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত যেন গৃহীদের বেদে পরিণত হয়েছে । ফলে হয়েছে অশাস্ত্রীয় বিভ্রান্তি । এর গােড়ায় আছে ঐ তথাকথিত মােক্ষধর্ম । উপযুক্ত সময় আসার আগেই সবাইকে , অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে মােক্ষের পেছনে ছােটানাে । তারই অমােঘ পরিণাম — তাকে কর্তব্য ভুলিয়ে দেওয়া । সাধারণ মানুষের জন্য আমাদের শাস্ত্রে স্পষ্ট করে চতুর্বর্গ বা চার পুরুষার্থ পালনের কথা বলা হয়েছে । ধর্ম অর্থ কাম মােক্ষ । এই চার পুরুষার্থের ব্যাখ্যা অনেকে অনেকরকম ভাবে করেন । কিন্তু যেভাবেই করা হােক না কেন , ধর্ম ও মােক্ষের থেকে অর্থ ও কামের গুরুত্ব কোন অংশে কম দেওয়া হয়েছে কী ? এছাড়া শাস্ত্রে আছে , সমাজে ছিল চার আশ্রম । চূড়াওয়ালা আশ্রম নয় । জীবনের চারটি পর্যায় ও ব্রহ্মচর্য , গার্হস্থ্য , বাণপ্রস্থ , সন্ন্যাস । এখানেও কোনটার গুরুত্ব কম ? কোনটারই নয় । জীবনের শেষ পর্যায় সন্ন্যাস। তখন মােক্ষের চিন্তা । কিন্তু এই সকল পর্যায়েই ধর্ম থাকবে । কর্তব্যধর্ম । প্রত্যেক পর্যায়ের পৃথক পৃথক ধর্ম , অর্থাৎ পৃথক পৃথক কর্তব্য । সহজভাবে — ব্রহ্মচর্য্য পর্যায়ের ( ছাত্রাবস্থা ) কর্তব্য শিক্ষালাভ ও সংযমের দ্বারা নিজেকে তৈরী করা , গার্হস্থ্য পর্যায়ের কর্তব্য বংশরক্ষা বা প্রজাবৃদ্ধি , পরিবারের উন্নতি ও সুপরিচালনা , সমাজের সম্পদ বৃদ্ধি , অতিথি সেবা ও বিভিন্ন সামাজিক দায়দায়িত্ব ( ভূমিকা ) পালন করা ; বাণপ্রস্থ পর্যায়ের কর্তব্য ঃ পরিবারের উন্নতি ও মঙ্গলকামনার গণ্ডিটাকে অতিক্রম করে শুধু সমাজের কল্যাণে নিজেকে নিযুক্ত করা । সর্বশেষে সন্ন্যাস পর্যায়ে পরিবার , সমাজ সবকিছুকে তুচ্ছ করে বিশ্বনির্মাতার কাছে পৌঁছানাে বা পরমাত্মার সঙ্গে নিজ আত্মাকে একীভূত করে দেওয়ার সাধনায় রত হওয়া , যার নাম মােক্ষের জন্য সাধনা । এই চারটি পর্যায়ের কর্তব্য শিক্ষা দেওয়াই ধর্মশিক্ষা । তাই , শ্রীরামকৃষ্ণের ‘ কামিনী কাঞ্চন ত্যাগ করার উপদেশ কখনই গৃহীদের জন্য সঠিক হতে পারে না । এতে বিভ্রান্তি ও অনর্থ হওয়ার সম্ভাবনা । এর থেকে আমি বনেদী মাড়ােয়ারীদের কাছ থেকে যে conventional wisdom -এর কথা শুনেছি — তাকে অধিকতর উপযুক্ত মনে হয়েছে । এই মাড়ােয়ারী ব্যবসায়ীরা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উপদেশ পেয়েছে , “ শাে হাত সে কামাও , হাজার হাত সে বাঁটো ” । আবার একটু সাফাই গেয়ে এই চতুর্থ পর্যায়ের লেখাটা শুরু করি । নিজের প্রতি অভিযােগ করছি হঠাৎ ধর্মের সংস্কার নিয়ে লিখতে লাগলাম কেন , আর এ বিষয়ে আমার লেখার অধিকারই বা কী ? উত্তর – আজ পৃথিবীতে মুসলমানদের জন্য ঘােষিত ভাবে ৫৭ টি দেশ আছে । তারা শুধু মুসলমানদের রক্ষাই করবে না , ইসলাম ধর্মের সংরক্ষণ ও সংবর্ধনের জন্য তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও কর্মরত । খ্রীষ্টান ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে স্বীকার করে অথবা খ্রীষ্টান ধর্মকে সর্বপ্রকারে সংরক্ষণ ও প্রসারে সক্রিয় দেশ ৭০ টি । আমাদের হিন্দু ধর্মের জন্য একটা দেশও আছে ? একটা মাত্র ছােট্ট দেশ হিন্দুরাষ্ট্ররূপে ঘােষিত ছিল , নেপাল । সে দেশও হিন্দুরাষ্ট্রের ছাপ মুছে ফেলে হিন্দুবিরােধী হওয়ার দিকে নিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে । হিন্দুধর্মের নিজের দেশ এই ভারতে নবীন প্রজন্মকে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি শিক্ষা দেওয়ার তিলমাত্র ব্যবস্থা কোথাও দেখেছেন ? স্বাধীনতার পর তৃতীয় প্রজন্ম (২৫ বছরে এক প্রজন্ম ধরে) চলছে । স্কুলে কলেজে কোথাও হিন্দুধর্ম , সংস্কৃতি , মূল্যবােধ , শাস্ত্র , অনুষ্ঠান কোন কিছু শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই । তার উপর এই দেশে হিন্দুরা কী ব্যবহার পায় – তা অমরনাথ যাত্রা , মানস সরােবর যাত্রা ও গঙ্গাসাগর মেলার সঙ্গে হজ যাত্রার তুলনা করলেই সহজে বােঝা যাবে । তাহলে কী দাঁড়াল ? দাঁড়াল এই যে হিন্দুধর্মের সংরক্ষণ ও সংবর্ধনের জন্য এবং হিন্দুদের জন্য পৃথিবীতে একটাও দেশ নেই । এর জন্য দায়ী কে ? নিশ্চয় চুনােপুঁটিরা নয় , দায়ী সমাজের মাথারা । এই মাথাদের মধ্যে ধর্মীয় মাথারাও পড়েন । তাঁদের সুযােগ্য নেতৃত্বে আজ পৃথিবীতে হিন্দুদের জন্য একটিও দেশ নেই। এরকম একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলেই আমার মত অর্বাচীন ও অনধিকারীকে ধর্মের সংস্কারের জন্য কলম ধরতে হয়েছে । হিন্দু ধর্মের চূড়ান্ত লাঞ্ছনা অপমান দেখে কোন যুবক যদি এর প্রতিকারে কোন বিশেষ পদক্ষেপ নিতে চায় , অমনি বয়স্করা ও আমাদের ধর্মের ধ্বজাধারীরা বলবেন —তােরা রক্ষা করবি এই ধর্মকে ! ওরে , এ হচ্ছে সনাতন ধর্ম , এর নাশ নেই । স্বয়ং ভগবান এই সনাতন ধর্মকে সৃষ্টি করেছেন । তিনিই একে রক্ষা করবেন । তােদের কি ক্ষমতা ? যারা এই সব কথা বলেন , তাঁরা সম্পূর্ণ ভুল কথা বলেন। এ হচ্ছে নিষ্কর্মার যুক্তি । এ হচ্ছে নির্বোধের যুক্তি । এ হচ্ছে গা বাঁচানাে কথা । এ হচ্ছে ভাগ্যবাদী কাপুরুষের কথা । এটা ঠিক যে সনাতন ধর্মের নাশ নেই । কিন্তু গান্ধারে তাে আজ সনাতন ধর্ম নেই , নেই সিন্ধপ্রদেশে , নেই বালুচিস্তানে , নেই লাহােরে , নেই রাওয়ালপিন্ডিতে , নেই অনন্তনাগে , নেই বারামূলায় । তাহলে ? তাহলে এই যে , এতগুলাে জায়গায় যদি আজ সনাতন ধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়ে থাকে , তাহলে আগামী দিনে দিল্লী , কলকাতা , ইন্দোর , নাগপুরেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে । সনাতন ধর্ম যদি অমর হয় , তাহলে ওয়াশিংটন , নিউইয়র্ক , টোকিও , লন্ডনে সে ধর্ম বেঁচে থাকবে । সাহেব , মেম , জাপানিরা সনাতন ধর্ম পালন করবে । আর ভারতটা কাবুল , কান্দাহার , করাচীর মত ইসলামিক স্থান হয়ে যাবে । আর বাদামী চামড়ার আমরা বা আমাদের বংশধররা হবে মুসলমান বা খ্রীষ্টান । অর্থাৎ সনাতন ধর্ম বেঁচে থাকবে ইউরােপ আমেরিকায় । কিন্তু “ হুঁ হুঁ বাবা , সনাতন ধর্মের নাশ নেই ” বলে গর্ব করার মত লােক এদেশে অবশিষ্ট থাকবে না । তাই , ভগবান যদি হিন্দু ধর্মটাকে রক্ষাও করেন , তবু হিন্দুদের রক্ষা করার ভার নেবেন না । ইতিহাস তার সাক্ষী । সুতরাং , হিন্দু বা সনাতন ধর্মকে রক্ষা ভগবান করুন । কিন্তু হিন্দুদের রক্ষা ও তাদের বাসস্থান রক্ষা করার দায়িত্ব তাদের নিজেদেরকেই নিতে হবে । আমরা তাদের মধ্যেই পড়ি। তাই সে কাজ আমাদেরই কর্তব্য । এই কর্তব্য আমরা হিন্দুধর্মকে অবলম্বন করেই করব । আর তার জন্যই হিন্দুধর্মকে যুগােপযােগী করার দায়িত্ব আমাদেরই । এটা আমাদের কর্তব্য , এটা আমাদের অধিকার । আমাদের যে সকল পূর্বপুরুষদের ও ধর্মীয় গুরু ও ব্রাহ্মণদের পরিচালনায় হিন্দুধর্ম লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছে , হিন্দু সমাজ ছােট ( সংখ্যায় ) হয়েছে , হিন্দুদের দেশ ছােট হয়েছে , হিন্দুরা মার খেয়েছে , তাঁদেরকে আমরা প্রণাম করব , কিন্তু আমরা তাঁদের অনুসরণ করব না । তাহলে কাকে অনুসরণ করব ? আমাদের ধর্মের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যাঁরা হেরেছেন তাঁদেরকে নয় , যাঁরা জিতেছেন তাঁদেরকে অনুসরণ করব । রাম আর কৃষ্ণ যদি লঙ্কা ও কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে হেরে যেতেন , হরিভক্তরা নিজের বুকে হাত দিয়ে বলুন তাে , তাহলে রাম আর কৃষ্ণ আমাদের ভগবান বা অবতার হতেন কি ? দেবতারা যদি অসুরদের পরাস্ত করে স্বর্গ পুনরুদ্ধার না করতে পারতেন , তাহলে তাঁরা আমাদের কাছে দেবতা হতেন না । তাই যদি আধুনিক ডায়ালগ ধার নিই “ যো জিতা ওহী সিকন্দর ” , তেমনি “ যাে জিতা ওহী অবতার ” তাহলে হয়ত অনেক ধার্মিক মনে ব্যথা পাবেন , কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারবেন কি ? সুতরাং , আমাদের জিততে হবে । সেটাই ধর্ম । ন্যায় নীতিকে বাদ দিয়ে নয় । কিন্তু খুব ভাল করে মনে রাখতে হবে ন্যায় নীতিকে ধরে রেখে হারলাম , মার খেলাম , পালালাম— এটা কখনও ধর্ম হতে পারে না , পারেনা , পারেনা । আগেইবলেছি , বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভূমিকায় সঠিক কর্তব্য পালন করাইহল ধর্ম । যুদ্ধের সময় কতব্য কী ? যুদ্ধের সময় জেতাটাই হল সব থেকে বড় ধর্ম । মহাভারত এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে এর অসংখ্য উদাহরণ আছে । জরাসন্ধ , ভীষ্ম , দ্রোণাচার্য্য , কর্ণ , দুর্যোধনকে বধ করতে সকল ন্যায় নীতিকে পাশে সরিয়ে রেখে কৃষ্ণ যত রকমের ছল ও কৌশল অবলম্বন করেছেন , আজ যদি আমাদের ধর্মের শত্রুদের বিরুদ্ধে ওইগুলি প্রয়ােগ করার কথা বলি , অনেকে আঁতকে উঠবেন । তাঁদের অনেকে আবার একটা বাহানা শুরু করেছেন । তাঁরা বলেন , কৃষ্ণের এসবই লীলা । সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে না । তাই কৃষ্ণের অনুকরণ না করে আজকের মানুষের রামের অনুকরণ করা উচিত । সাধারণ মানুষের আচরণের জন্য রাম আদর্শ পুরুষ । সেইরামও যুদ্ধের সময় কী করেছেন ? লক্ষণ রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎকে কিভাবে মেরেছিল ? ইন্দ্রজিৎ তখন নিকুম্ভিলা যজ্ঞ করছিল । নিঃশস্ত্র ছিল , সেই অবস্থায় লক্ষ্মণ তাকে মেরেছিল । সে অনুরােধ করা সত্ত্বেও তাকে অস্ত্র নিতে দেয়নি । রাম কি একথা জানতেননা ? তিনি কি একাজ করতে লক্ষণকে নিষেধ করেছিলেন ? পরে তিরস্কার করেছিলেন ? রামায়ণ বলছে —না । বরং , বিভীষণের কাছ থেকে জানতে পেরে তিনিই লক্ষণকে পাঠিয়েছিলেন ইন্দ্রজিতের যজ্ঞ ভাঙতে এবং তাকে বধ করতে । তাহলে রাম কৌশল অবলম্বন করেন নি ? করেছিলেন । কারণ , যুদ্ধের সব থেকে বড় ধর্ম হল জেতা।রাম সেই ধর্মপালন করেছিলেন। তাছাড়া , ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করত । সামনে আসত না । তাই তাকে মারতে কৌশল অবলম্বন করা পাপ নয় । আজ আমাদের ধর্মের যারা শত্রু , তারা সব রকমের ছল , চাতুরি , পাশবিকতা করছে । তাই তাদের সঙ্গে মানবিক ব্যবহার করে পরাজিত ও ধ্বংস হওয়া ধর্ম নয় । তাদের সঙ্গে ওই একই রকম ব্যবহার করে তাদেরকে পরাজিত করাটাই ধর্ম । জেতাটাই ধর্ম । আমাদের সেই ধর্ম পালন করতে হবে , জিততে হবে । এটাই কৃষ্ণের শিক্ষা , এটাই রামের শিক্ষা । আমাদের হিন্দু ধর্মের একটা গুরুত্ব পূর্ণ সংস্থা হল মন্দির । বােধহয় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ । খুব বড় সংখ্যার মানুষ মন্দিরে যাওয়া ও পূজা দেওয়াকেই ধর্মের একটা প্রধান কাজ বলে মনে করে । তীর্থযাত্রাকেও ধর্মের কাজ বলে মনে করা হয় । কিন্তু তীর্থ করতে কম লােক যায় । যারা যায় , তারাও তীর্থে গিয়ে কোন মন্দিরেই যায় । সুতরাং , এই মন্দিরগুলিতে ভূমিকা ও কার্যাবলীর একটু পর্যালােচনা করা দরকার । এগুলি আমাদের ধর্মের ও সমাজের প্রকৃত চাহিদাকে মেটাতে পারছে কিনা এবং ধর্ম ও সমাজের সামনে সমস্যাগুলির সমাধানে কোন অবদান রাখতে পারছে কিনা । কেউ হয়ত প্রশ্ন তুলতে পারেন যে একজন ব্যক্তি মন্দিরে যায় তার ভগবানকে ডাকার জন্য । এখানে সমাজের কথা আসছে কেন ? তার উত্তরে বলতে হয় , ভগবানকে তাে ঘরে বসেই ডাকা যায় । সব স্থানে ভগবান বিরাজমান – আমরা তাে একথা বিশ্বাস করি । তাহলে শুধু ভগবানকে ডাকার জন্য মন্দিরে যেতে হবে কেন ? মন্দির তৈরীই হয়েছে ব্যক্তির জন্য নয় , সমাজের জন্য । সুতরাং , মন্দির মানেই মিলন স্থান , বিনা স্বার্থে , ভগবানের নামে , ধর্মের জন্য । প্রকৃত ঘটনা হল , মন্দির আমাদের ধর্মের খুব পুরানাে সংস্থা নয় । বেদে , রামায়ন বা মহাভারতে মন্দিরের উল্লেখ খুঁজে পাওয়া খুব দুস্কর । রামায়ণ মহাভারতে আশ্রম আছে , তপােবন আছে , তীর্থস্থান আছে , দেবতার বিগ্রহ সমন্বিত মন্দির দেখা যাচ্ছে । এমনকি রামচন্দ্র সমুদ্র পার হওয়ার আগে রামেশ্বরমে যে শিব পূজা করলেন , তাও একটি শিব লিঙ্গ বানিয়ে নিয়ে , কোন শিবমন্দিরে গিয়ে নয় । প্রাচীনকালে আমাদের সমাজে কুলদেবতা ছিলেন , গ্রামদেবতাও ছিলেন । কিন্তু গ্রামদেবতাদের মন্দিরের বাহুল্য চোখে পড়ে না । আমাদের সমাজে প্রথম ব্যক্তিপূজার বাড়াবাড়ি শুরু হল বুদ্ধদেবের সময় তাঁকে নিয়ে । তিনি শিষ্যদের অতীব ভক্তির পাত্র হলেন । তিনি বললেন – বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি , সংঘং শরণং গচ্ছামি , ধর্মং শরণং গচ্ছামি । তাঁর অধিকাংশ শিষ্য প্রথমটা নিল , আর দুটো নিতে পারল না । তার থেকে কিছু কম শিষ্য দ্বিতীয়টাকেও নিল । আর অতি অল্প শিষ্য তৃতীয়টাকেও নিতে পারল । সবাই মিলে তাঁকে এত উচু স্থানে বসাল যে তিনি শিষ্যদের কাছে দেবতা হয়ে গেলেন । কিন্তু দু হাত-পাওয়ালা দেবতাদেরও মৃত্যু হয় । বুদ্ধদেবেরও মৃত্যু হল । কিন্তু ততদিনে বুদ্ধ পূজা এতদূর এগিয়ে গিয়েছে যে তার শরীরের কোন অংশ নখ – চুল ইত্যাদি কোন স্মৃতিচিহ্নকে রক্ষা করার জন্য শিষ্যরা আকুল হয়ে পড়ল । সেগুলিকে রক্ষা করার জন্য বিরাট বিরাট স্তুপ নির্মাণ হল । এই বৌদ্ধ স্তূপ গুলিই হল হিন্দু মন্দিরের পূর্বসূরী । তাই বুদ্ধ পূর্ববর্তী রামায়ন মহাভারতে মন্দিরের ভূমিকার কথা পাওয়া যায় । তখন সাধারণ মানুষের কাছে ধর্ম মানে ছিল ‘ কর্তব্য ধর্ম । আর ধর্মের অনুষ্ঠান বলতে ছিল হােম , যাগযজ্ঞ ও তীর্থযাত্রা । আবার এই যাগযজ্ঞও যাতে অনুষ্ঠান সর্বস্ব না হয়ে যায় , তার জন্য মহাভারতে সবিস্তারে সেই স্বর্ণ নকুলের গল্প বলা হয়েছে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময় । যাক , মন্দির তাে হল । কিন্তু আমাদের ধর্মের গবেষণা ও অভিজ্ঞতালব্ধ কোন স্বাভাবিক বিকাশের ফলে হল না । হল কিছুটা অনুকরণে ও কিছুটা পরিস্থিতির চাপে । সুতরাং , মন্দিরের ভুমিকা স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হল না । তাই বলে মন্দিরের গুরুত্ব কিছু কম হল না । এখন দেখা যাক , আমাদের মন্দিরগুলি কী ভূমিকা পালন করছে ও কী করা উচিত । আমি দিল্লিতে চার বছর একটি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় মন্দিরেই ছিলাম । তাছাড়া বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের কাজের সূত্রে বহু মন্দির আমাকে ঘন ঘন যেতে হত । এছাড়া জম্মু কাশ্মীরে একটি অতি প্রাচীন মন্দির , পুঞ্জে অবস্থিত বুড়া অমরনাথ মন্দিরের প্রাচীন ছড়ি যাত্রাকে নবজীবন দান ও জনপ্রিয় করার কর্মসূচীর প্রধান দায়িত্বে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে । এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশ ও বাংলাদেশে মন্দিরগুলিতেও বার বার যাওয়ার অভিজ্ঞতা তাে আছেই । এসব থেকে যা দেখতে পেয়েছি তা হল , এই মন্দির গুলি আমাদের ধর্মের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে । মন্দির সমাজের সাধারণ অর্থাৎ গৃহস্থ মানুষের জীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে । বাংলায় একটু কম । মন্দিরে গিয়ে দেববিগ্রহ দর্শন করা , পূজা দেওয়া ও দক্ষিণা দেওয়াকে মানুষ কর্তব্য বলেই মনে করে । মন্দির আমাদের আস্থার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে । এই আস্থাই আমাদেরকে শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত রাখছে । এটা অত্যন্ত প্রয়ােজন । আমার অনুমান – মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে সংখ্যালঘু তােষণের চরম কু-পরিণামে হিন্দুদের ধর্মান্তরের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেত । এছাড়া অনেক স্থানে মন্দিরগুলি সমাজের মিলনকেন্দ্রেও পরিণত হয়েছে । এগুলি হল মন্দিরের ভাল দিক । কিন্তু ঘাটতি ও অনেক আছে যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক । প্রথমত , মন্দিরে প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত আসে , শিবপূজা করে । কিন্তু ওই ভক্তরা যদি শােনে সেখান থেকে মাত্র এক কিলােমিটার দূরে আর একটি শিবমন্দিরের উপর বিধর্মী বা দুষ্কৃতকারীদের হামলা হয়েছে , অথবা পুলিশ এসেছে ভাঙতে , কতজন সেখানে ছুটে যাবে ? খুব কম । তখন এই দ্বিতীয় মন্দিরের কর্তৃপক্ষ বা পূজারী ছুটবেন কোন হিন্দু সংগঠনের দপ্তরে সাহায্য চাইতে । পাশের মন্দিরে ছুটবেন না । সুতরাং একটি মন্দির তার ভক্তদের আস্থা ধরে রাখতে পারে , কিন্তু অন্য মন্দির বা ধর্মস্থান রক্ষায় ছােটাতে পারেনা , অনুপ্রাণিতকরতে পারে না । পাঠক একটু চিন্তা করুন তাে – একটা মসজিদে হামলা হয়েছে খবর ছড়ালে মুসলমানরা কী করে ? আশা করি বলে দিতে হবে না । তাই যতটা সহজে মন্দিরে ভাঙে , ততটাই সহজে মসজিদ গড়ে ওঠে । আর মন্দির ভাঙা যে দেশ ভাঙারই পূর্বধাপ , তা বুঝতে খুব বেশী মেধার দরকার হয় না । দ্বিতীয় একটি খুব বড় ঘাটতি – আমাদের মন্দিরগুলিতে নিয়মিত কোন ধর্মীয় উপদেশ দেওয়া হয় না । ধর্মীয় উপদেশ মানে দেশ ধর্ম সমাজের প্রতি কী কর্তব্য – সেই উপদেশ । অথচ মসজিদে ‘ খুৎবা ’ দেওয়া হয় , চার্চে ‘ ‘সারমন ” দেওয়া হয় । ইমামের দেওয়া শুক্রবারের ‘খুৎবা’তে বুশ থেকে বাজপেয়ী , লাদেন থেকে তােগাড়িয়া আর প্যালেস্টাইন থেকে আফগানিস্থান – সবই আসে । ফলে মুসলিমরা গুজরাট জানে , হিন্দুরা গােধরা জানেনা । মুসলমানরা গােলাম কাশ্মীর জানে , হিন্দুরা মানহারা নােয়াখালি জানে না । আজও সাধারণ বাঙালি হিন্দু দেগঙ্গার কথা জানে না । কারণ , আমাদের মন্দির গুলি ভক্তের সঙ্গে ভগবানের মিলন ঘটিয়েছে । কিন্তু ওই ভগবানেরই এক ভক্তের দুঃখ বেদনার কথা আর এক ভক্তের কাছে পৌছে দিতে পারেনি । এটা আমাদের মন্দিরের ব্যর্থতা । এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে , মন্দিরগুলিকে আরও সংবেদনশীল করে তুলতে হবে । তার জন্য মন্দির পরিচালন ব্যবস্থার পরিবর্তন করে নতুন পদ্ধতি শুরু করতে হবে । এবার একটি অপ্রিয় প্রসঙ্গে আসতেই হবে , অনেক মন্দির সরকার অধিগ্রহণ করে নিচ্ছে বলে আমরা কেউ ব্যথিত , কেউ ক্রুদ্ধ । এই ক্রোধ অত্যন্ত ন্যায্য । আমাদের দেশের দু-নম্বরি ধর্মনিরপেক্ষতার বদমায়েসীতে হিন্দুর মন্দির দখল কর , কিন্তু মসজিদ গীর্জার গায়ে হাত দিও না । শয়তানী ধর্মনিরপেক্ষতার এই দুমুখাে নীতি আমরা জানি । কিন্তু …… একটা প্রশ্ন আমার তাে মনে আসে , একটা উদাহরণ সহ বলা যাক । কালীঘাট বা তারাপীঠের মন্দির । ভক্তরা সারা বছরে সেখানে কোটি কোটি টাকা ও সােনা দিচ্ছে । কাকে দিচ্ছে ? মা কালীকে দিচ্ছে । মা কালী তাে ওই টাকা ভােগ করছে না । তাহলে ঐ টাকার মালিক কে হবে ? এবং ঐ টাকা কী কাজে লাগা উচিত ? মা কালীর কাজে অর্থাৎ ধর্মের কাজে নয় কি ? নাকি কোন এককালে যিনি ঐ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন , তাঁর বংশধররাই শুধু ঐ টাকার মালিক হবেন ? কোন যুক্তিতে , কোন্ যােগ্যতায় ? মা কালীর উদ্দেশ্যে দেওয়া ঐ টাকা দিয়ে তারা মা কালীর কাজ বা ধর্মের কিছু করছেন । কি ? না , করছেন না । হ্যা , মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় কিছু খরচ আছে । কিন্তু দক্ষিণা তাে তার থেকে অনেক অনেক বেশী পড়ে । সেই অর্থে কি ধর্মের কাজ হওয়া উচিত নয় ? আমাদের দেশের ও রাজ্যের হিন্দু বিরােধী সরকারগুলি উর্দু , আরবী ও ফারসী ভাষার সংরক্ষণ ও প্রসারে হিন্দুর ট্যাক্সের টাকা জলের মতাে খরচ করে । আর আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির ভিত্তি সংস্কৃত ভাষাকে টুটি টিপে মেরে ফেলতে চায় । এটাই তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা , এটাই তাদের সাম্যবাদ , এটাই তাদের প্রগতিশীলতা। তাদের কাছে বিদেশী আরবী ও পাকিস্তান সৃষ্টিকারী উর্দু প্রগতিশীল , আর সংস্কৃত প্রতিক্রিয়াশীল । এটা তাে আমরা সবাই জানি । কিন্তু … যে সংস্কৃত আমাদের ধর্মের ধারক , শাস্ত্র , দেবতা , ভক্তের পূজা মন্ত্রের ভাষা , সেই ভাষাকে সংরক্ষণের জন্য অধিক আয়ের মন্দিরগুলি কি সামান্য একটু ভূমিকা পালন করতে পারতােনা ? যে সকল মন্দিরের অতিরিক্ত আয় আছে , তাদের প্রত্যেককে একটা করে অবৈতনিক , এবং সম্ভব হলে নিঃশুল্ক আবাসিক সংস্কৃত টোল চালাতে হবে । শুধু সোনিয়া-বুদ্ধ-মমতাকে গাল দিলে আমাদের কর্তব্য সমাধা হবে না । দ্বিতীয় একটি কাজ মন্দিরকে করতে হবে । যে সকল প্রাচীন মন্দির ভগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে ও যেগুলি কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় , তার মধ্যে বিশেষ করে যেসব এলাকায় হিন্দুর সংখ্যা খুব কমে গেছে , সেই রকম এক একটি জীর্ণ মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিত্য পূজার দায়িত্ব নিতে হবে এক একটি স্বচ্ছল মন্দিরকে । এই স্বচ্ছল মন্দিরগুলি আরও তিনটি কাজ খুব সহজেই করতে পারে । করা উচিত । ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে একটি লাইব্রেরী করা মন্দির সংলগ্ন । আমাদের দেশে ধর্মীয় পুস্তকের প্রতি আগ্রহ কোনদিন কমবে না । গীতা , চন্ডী , ভারতের সাধক , তপােভূমি নর্মদা প্রভৃতিবই চিরদিনইমানুষ পড়বে । তাহলে দু-একজন ভক্তের পরিচালনায় দু-একজন কর্মচারী রেখে একটি লাইব্রেরী কেন চালাবেন না মন্দির কর্তৃপক্ষ ? দ্বিতীয় কাজটি বােধহয় আরও সহজ । প্রত্যেক স্বচ্ছল মন্দির একজন করে শিক্ষিত তরুণ গবেষক নিযুক্ত করুক । আমাদের জাতির সম্বন্ধে একটা বড় অভিযোেগ যে আমাদের পূর্বপুরুষরা লিখিত , ডকুমেন্টেড ইতিহাস রেখে যাননি । ফলে আমাদের ইতিহাস জানতে হিউ-এন-সাঙ , ফা-হিয়েন , বাবরনামা , আকবরনামার শরণাপন্ন হতে হয় । আমাদের শাস্ত্র আছে , পুরাণ আছে , কাব্য , মহাকাব্য , দর্শন , ব্যাকরণ- সব আছে । ইতিহাস নেই । কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর থেকে প্রায় ২৬০০ বছরের আমাদের ইতিহাস খুবই অস্পষ্ট । প্রায় নেই । রাজাদের ইতিহাসও নেই , সাধারণ মানুষের জীবনকাহিনীও নেই । এখন বড় মন্দিরগুলি যদি একজন করে মধ্যমানের ও তরুণ গবেষক নিযুক্ত করেন , তাহলে আমাদের ইতিহাস আমাদের লােকের দ্বারাই লেখা হবে , কোন রাজানুগৃহীত দরবারী ঐতিহাসিকের দ্বারা নয় । এই গবেষকের কাজ হবেঃ ( ১ ) উক্ত মন্দিরের ও আশেপাশের মন্দিরগুলির ইতিহাস , যতটা পাওয়া যায় , সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করা , ( ২ ) ওই মন্দিরের বর্তমান কার্যাবলী ও অনুষ্ঠান তারিখ দিয়ে লিপিবদ্ধ করা , এবং ( ৩ ) উক্ত এলাকার চলমান আর্থ সামাজিক , ধামিক ও সাংস্কৃতিক গতিবিধিকে লিপিবদ্ধ করা । মন্দির কর্তৃপক্ষ দ্বারা বছরে একটি বা দুটি সংকলনে এগুলিকে ছেপে প্রকাশ করা । আর আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে কম্পিউটারে ডিজিটাল ফর্মে ও ডিভিডি-র দ্বারা সংরক্ষণ করা । এই সম্পূর্ণ কাজের মান যদি খুব উন্নত না হয় , তাহলেও চলবে । শুধু ভারতীয় ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী বজায় রাখতে হবে । লাল আর নীল ( শ্রীমতি টেরিজা ) চশমা দিয়ে না দেখলেই হবে । তৃতীয় কাজটিও খুব কঠিন নয় । সপ্তাহে বা পক্ষে বা মাসে একটি করে কথা বা প্রবচনের আয়ােজন করা । সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয় হলে তাে খুবই ভাল হয় । তাতে যদি বিতর্ক আসে , তাহলে ধর্মীয় ও শাস্ত্রীয় বিষয় নেওয়া যেতে পারে । উপনিষদ পুরাণের কাহিনী , রামায়ণ মহাভারতের কথা , কেউ আপত্তি করবে না । শুধু মন্দির পরিচালক নিজেদের তমােগুণী জড়তা একটু ঝেড়ে ফেলে রজোগুণী উদ্যম নিয়ে লাগুন তাে ! আর খুব বড় মন্দির যেগুলি আছে , তাদের আরও দুটি কাজ করা দরকার । কেউ কেউ ইতিমধ্যেই করছেন । যেমন আদ্যাপীঠ ও মায়াপুরে ইস্কন । এক , একটি গােশালা চালু করা , ব্যবসার জন্য নয় । অর্থাৎ জার্সি গাই রাখলে চলবে না । দেশী গাই ও ষাঁড় রাখতে হবে । গরুর দেশী প্রজাতিকে বাঁচাতে হবে । এ কর্তব্য কি মন্দিরের নয় ? শুধু আনিসুর রহমানের ? দ্বিতীয় , যে মন্দিরের অধীনে দেবােত্তর কৃষি জমি আছে , তারা সেই জমির কমপক্ষে এক চতুর্থাংশে হাই ব্রীড বাদ দিয়ে দেশী পরম্পরাগত বীজ দিয়ে ফসল ফলান । বিশেষ করে ধান ও গম । ভারতে ত্রিশ হাজার প্রজাতির ধান ছিল । এগুলি ছিল দেশের সম্পদ , বিশ্ব প্রকৃতির সম্পদ । হাইব্রীডের দাপটে এই সব প্রজাতি নষ্ট হতে বসেছে । এগুলি সংরক্ষণের কিছুটা দায়িত্ব কি বড় মন্দিরগুলাের নেওয়া উচিত নয় ? সব দায়িত্বই কি সােনিয়া গান্ধী আর শরদ পাওয়ারদের ? মন্দির সম্বন্ধে আমার কথাই শেষ কথা নয় । কিন্তু সােমনাথ মন্দিরের কথা পাঠক ভেবেছেন কি ? গজনীর সুলতান মামুদ ৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দে গজনীর তখতে বসে ১০০০ খ্রীঃ থেকে ১০২৬ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ১৭ বার গুজরাটের সােমনাথ মন্দির লুট করেছিল । লুটের পরিমাণ ছিল অকল্পনীয় । কিন্তু এ প্রশ্ন কি মনে আসে না যে একবার , দুবার , তিনবার মন্দির লুষ্ঠিত হওয়ার পরেও হিন্দুরা কেন আবার টাকা পয়সা সােনাদানা সেখানে দান করত ? ঐ মন্দিরের পূজারীরা কেন ভক্তদেরকে বলেন নি যে মন্দিরে টাকা না দিয়ে ওই টাকায় অস্ত্র কেনাে । আজ মন্দিরের পূজারী ও পরিচালক মন্ডলীকে স্মরণ করতে বলি – নগর পুড়িলে দেবালয় কি বাঁচে ? তাই নগরকে অর্থাৎ দেশকে রক্ষা করার জন্য আপনাদেরকেও কিছু কর্তব্য করতে হবে । মন্দিরের কার্যপ্রণালী ও দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন ও সংস্কারের দ্বারাই সেই কর্তব্য পালন করা যাবে । ধর্ম বিষয়ে আলােচনা করতে হলে আর একটি বিষয়কে কোন ভাবেই বাদ দেওয়া যায় না।তা হল বাঙালির দুর্গাপূজা । সবাই একবাক্যে বলবে যে বাঙালির জীবনে সব থেকে বড় উৎসব হল দুর্গাপূজা । বাঙালি নয় এমন যে কেউ , ভারতীয় বা বিদেশী , একথা শুনে ভাববে যে বাঙালিরা কত ধার্মিক । কিন্তু সত্যিই কি তাই ? ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের আগে একটা তুলনা করতে চাই । এটা ঠিক যে শতকরা ৮০-৯০ ভাগ বাঙালি হিন্দু দুর্গাপূজার উৎসবে কোন না কোনভাবে মেতে ওঠে । কলকাতা ও অন্য ছােটবড় শহরগুলিতে পূজার সময় ঠাকুর দেখার জন্য মানুষের স্রোত নয় , প্লাবন আমরা দেখি । এইবার একটু তুলনা করুন তাে এই ভিড়ের সঙ্গে রেড রােডের ঈদের নামাজ পড়ার ভিড়ের । এই দুই ভিড়ের চরিত্রের মধ্যে , আচরণের মধ্যে , অ্যাটিচুডের মধ্যে কোন তফাৎ আছে , না নেই ? দুর্গাপূজার ভিড়ের মধ্যে ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা , মা দুর্গার প্রতি ভক্তি কতটা দেখা যায় ? আর ঈদের নমাজের ভিড়ে তাদের ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা ও আনুগত্যের প্রতিফলন কতটা দেখা যায় ? এই দ্বিতীয়টা কি অনেক বেশী নয় ? দেশের প্রত্যেক শহরে আছে ঈদগাহ ময়দান । আর ওই ময়দান ছাড়িয়েও তারা তাে রাস্তা দখল করতে বেশী আগ্রহী । কিন্তু ময়দানই হােক আর রাস্তাই হােক , তার পাশে কতগুলাে চাউমিন , পরােটার দোকান বসে ? কতগুলাে বেলুন আর ভেঁপুবাঁশিওয়ালা ঘুরে বেড়ায় ? খুব বেশী নয় । কারণ , সেখানে মুসলমানরা তাে চাউমিন খেতে যায় না , নামাজ পড়তে যায় । তাই চাউমিন , বাঁশি ভেঁপুর বিক্রি বেশীনয় । আর আমাদের পূজার ভিড়ে ? বিশাল মেলা বসে যায় । তা নিয়ে আমরা গর্বও করি । তাতে আপত্তি নেই । কিন্তু , ঠাকুর দেখার নাম করে যারা ঐ মেলায় যাচ্ছে , তাদের মধ্যে ভক্তি কই , নিষ্ঠা কই ? যতটা টান মা দুর্গার প্রতি , তার থেকে বেশী টান চাউমিনের প্রতি । তার থেকেও বেশী টান মন্ডপ সজ্জার প্রতি । আর তার থেকেও বেশী টান স্মার্ট যুবক ও সুসজ্জিতা যুবতীদের পরস্পরের প্রতি । ঠাকুর দেখার সংখ্যা সারা বাংলায় লাখের অঙ্কে নয় , কোটির অঙ্কে যাবে । এই কোটি কোটি দর্শনার্থীদের মধ্যে ০.০০১ শতাংশও পূজোর সময় অঞ্জলি দেয় না । তাহলে বাঙালি হিন্দুর এই দুর্গাপূজায় মেতে ওঠা – এটা ভক্তি , নিষ্ঠা , না হুজুগ ? এই হুজুগেপনা নিয়ে ঈদের নামাজে অংশগ্রহণকারীদের নিষ্ঠা , আস্থা , আনুগত্য আর সংকল্পে দৃঢ়তার সামনে টেকা যাবে কি ? হ্যাঁ , এটা স্বীকার করতে হবে যে বিশেষ বিশেষ তিথিতে দক্ষিণেশ্বর , কালীঘাট , ঠনঠনিয়া প্রভৃতি কালীমন্দিরে যে লম্বা লাইন পড়ে , তাতে হুজুগ নেই । আছে ভক্তি ও বিশ্বাস । কিন্তু সেখানে যে এত ভক্তি সহকারে মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে । সেখানেও তাে উদ্দেশ্য ব্যক্তিস্বার্থ । এবং এতে কোন সামূহিক সংকল্প নেই , নেই কোন সামূহিক কামনা বাসনা । কিন্তু এই সামূহিক কামনাবাসনা আছে ঈদের নামাজে । তাই আমাদের মন্দির ভাঙ্গে , জবরদখল হয় , সরকারী অধিগ্রহণ হয় । আর ওরা নিজেদের মসজিদকে সুরক্ষিত রেখে জনগণের রাস্তার দখল নেয় । সুতরাং , দুর্গাপূজার রাত্রিগুলাের ওই লক্ষ কোটি মানুষের ভিড় প্রকৃতই হিন্দুধর্মের কোনরকম শক্তিবৃদ্ধি করে কিনা – এটা একটা বড় প্রশ্ন । এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায়িত্ব পাঠকদের উপরেই আমি চাপিয়ে দিচ্ছি । দেবী দুর্গার অকালবােধন করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র । কেন করেছিলেন ? রাবণবধের জন্য । দুর্গাপূজা তাে আমরা করি । কিন্তু শ্রীরামের অনুসরণ আমরা করি কি ? রামের জীবনবাণী দুর্গাপূজার হুজুগে ভক্তরা এতটুকুও বুঝতে পেরেছেন কি ? আমাদের ধর্ম শুধু আধ্যাত্মিকতা নয় , শুধু দেবতায় ভক্তি নয় , হুজুগ তাে নয়ই । আমাদের পবিত্র হিন্দু ধর্ম সমাজের সঙ্গে জড়িত , মানবতার সঙ্গে জড়িত , প্রকৃতির সঙ্গে জড়িত । বিশ্বে প্রথম গ্রন্থ যেমন ঋগ্বেদ , ঠিক তেমনি এই বিশ্বে দেশপ্রেমের প্রথম মন্ত্র উদগাতা শ্রীরাম । রাবণবধ ও লঙ্কা বিজয়ের পর অযােধ্যায় ফিরে আসার ব্যাপারে লক্ষণের অনিচ্ছা শুনে রাম বলেছিলেন । জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী । এই বাণীই হচ্ছে বন্দে মাতরম্ ধ্বনির বীজ বা পূর্বসূরী । যারা কমুনিষ্ট বা মার্কসবাদী , তারা ধর্ম মানে না , দেশকে ভালবাসে না , আমাদের মহাপুরুষ ও অবতারদেরকে অস্বীকার করে । তাই তাদের কথা বাদ ।। কিন্তু রামভক্তরা ? যারা রামের পূজা করেন , রামনবমীতে উপবাস করেন আর মনে করেন যে শুধুরামের নাম নিলেই মহাপুণ্য , তারা কি রামের এই দেশভক্তির কথা আদৌ জানেন ? জানলেও বােঝেন ? আর বুঝলেও পালন করেন ? সব গুলােরই উত্তর — না । সুতরাং , একথা স্পষ্ট যে রাম নাম করা রামভক্তদের থেকে আমাদের দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবীরা অনেক বেশীরামভক্ত ছিলেন । তারাই শ্রীরামের অধিক প্রিয় । ধর্মের উপর আলােচনা এবার বােধহয় গােটানাের সময় হয়ে এসেছে । তাই সারসংক্ষেপ হিসাবে কয়েকটা কথা বলার চেষ্টা করি । আমাদের ধর্ম শুধু অনুষ্ঠানে নয় । ধর্মের মূল হল – প্রেরণা , আস্থা , নিষ্ঠা ও সংকল্প । একসময় আমাদের সমাজে চার বর্ণ , চার আশ্রম ও চার পুরুষার্থ ছিল । বর্তমানে প্রথম দুটি অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে । কিন্তু চার পুরুষার্থের ( ধর্ম , অর্থ , কাম , মােক্ষ ) পালন সমানভাবে করতে হবে । সমাজে জ্ঞান , কর্ম ও ভক্তি কোনটারই যেন বাড়াবাড়ি না করা হয় । তিনটি মার্গকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে সবাইকে স্বাধীনতা দিতে হবে ও উৎসাহ দিতে হবে নিজ নিজ প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি অনুসারে মার্গ বেছে । নিতে । আমাদের ধর্মের অর্থ অত্যন্ত গৃঢ় ও অত্যন্ত ব্যাপক । কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য অনিবাৰ্য্যরূপে পালনীয় হল কর্তব্যধর্ম । তাই ভক্তি , নিষ্ঠা , জপ , তপ , পূজা , পাঠ , মােক্ষ ইত্যাদিতে বেশী জোর দিয়ে কর্তব্যে অবহেলা কোনমতেই ধর্ম নয় । দেশ ও সমাজের সঙ্গে আমাদের ধর্ম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত । তাই দেশ ও সমাজের প্রতি নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন না করে কেউ ধার্মিক হতে পারে না । বর্তমানে দেশধর্ম ও সমাজধর্ম পালন করা একান্ত কর্তব্য । যার দ্বারা আমরা সংকুচিত হই , আমাদের দেশ ও সমাজ আয়তনে , সংখ্যায় ও সম্মানে ছােট হয় তা অধর্ম । আর যা আমাদের দেশ ও সমাজকে আয়তনে সংখ্যায় ও সম্মানে বড় করে – তাই ধর্ম । নাল্পে সুখমস্তি , ভূমৈব সুখম্ । সুতরাং , ভারতের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অংশগুলিকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করাটাই ধর্ম । অর্থাৎ অখণ্ড ভারত ধর্ম , খণ্ডিত ভারত অধর্ম । যা মানুষকে নিষ্ক্রিয় করে , জড় করে , ভীত করে তা অধর্ম । যা মানুষকে সক্রিয় করে , সাহসী করে , শক্তিশালী করে – তা ধর্ম । রাজসিক গুণসম্পন্ন না হয়ে সাত্ত্বিক হওয়া যায় না । তাই সত্ত্বগুণের আগে রজোগুণ অর্জনের চেষ্টা করতে হবে । সমাজে ভেদাভেদ দূর করতে হবে । এটাই এখন যুগধর্ম । গুণ , যােগ্যতা ও কর্মের ভিত্তিতে কোন শ্রেণীকরণ হতে পারে । কিন্তু জন্মের ভিত্তিতে ছােট বড় নির্ধারিত হওয়া অধর্ম । এটা মেনে নেওয়া যাবে না । যেহেতু বর্ণপ্রথার আজ আর কোন স্থান নেই , তাই সকল কর্মে সকলের অধিকার দিতে হবে । ব্যক্তির যােগ্যতা থাকলে তার জন্ম বা শ্রেণী দিয়ে কোন প্রকার কর্ম থেকে তাকে বঞ্চিত করা যাবে না । সম্পূর্ণ সমাজকে করতে হবে স্বাভিমানী ও নিজ ধর্ম সংস্কৃতির প্রতি আস্থাবান । আর যুবসমাজকে করতে হবে বীর ধর্মে অনুপ্রাণিত । দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন , দেশ সমাজ ও সংস্কৃতি রক্ষা ধর্মের সব থেকে বড় পরিচয় । সংকলন শুভঙ্কর নাগ সংগৃহীত স্বদেশ সংহতি সংবাদ নভেম্বর-ডিসেম্ব্যার ২০১০ জানুয়ারী-এপ্রিল-মে-জুন ২০১১#suparhumanTAPANGHOSH