লেখক পথপ্রদর্শক মাননীয় তপন ঘোষ প্রতি চার বছর পর পর ভারতকে এই লজ্জার মুখােমুখি হতে হয় । বিপুল লজ্জা । ১২৫ কোটি মানুষের দেশ অলিম্পিকে একটাও সােনার পদক জিততে পারে না । দু-একটা রূপাে আর ব্রোঞ্জের পদক নিয়েই ফিরে আসতে হয় । অথচ বিশ্বের নামকরা শক্তিশালী দেশগুলি তাে বটেই , এমনকি ছােট ছােট অতি দরিদ্র দেশগুলিও অলিম্পিকে বিভিন্ন খেলায় ও ইভেন্টে অনেক পদক পায় । আমাদের খেলােয়াড়রা পায় না কেন ? কেন ভারতবাসীকে এই বিপুল লজ্জা বহন করতে হয় প্রতি অলিম্পিকে ? দরিদ্র দেশ জামাইকা । জনসংখ্যা মাত্র ৩০ লক্ষ । আমাদের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার জনসংখ্যা ১ কোটিরও বেশি । জামাইকা এবার অলিম্পিকে ৬ টি সােনাসহ মােট ১১ টি পদক পেয়েছে । সার্বিয়া নামক দেশের জনসংখ্যা ৭২ লক্ষ । তারা পেয়েছে ২ টি সােনা , ৪ টি রূপাে সহ ৮ টি পদক । সােভিয়েত রাশিয়া থেকে ভেঙ্গে বের হওয়া বেলারাস নামে একটি ছােট্ট দেশ যার জনসংখ্যা মাত্র ৯৬ লক্ষ , তারা পেয়েছে ১ টি সােনাসহ ৯ টি পদক । আজারবাইজান – এর জনসংখ্যা ৯৮ লক্ষ । পদক । জিতেছে ১৮ টি । পােলান্ডের জনসংখ্যা ৪ কোটির কম । ২ টি সােনাসহ পদক পেয়েছে ১১ টি । সুইডেনের জনসংখ্যা ৯৮ লক্ষ । পদক ১১ টি । কানাডার জনসংখ্যা সাড়ে ৩ কোটি । পদক ৪ টি সোনাসহ ২২ টি । ক্রোয়েশিয়া জনসংখ্যা মাত্র ৪৫ লক্ষ । পদক ৫ টি সােনাসহ মােট ১০ টি । কেনিয়া জনসংখ্যা সাড়ে ৪ কোটি । পদক ৬ টি সােনা , ৬ টি রূপাে , ১ টি ব্রোঞ্জ । মােট ১৩ টি । ডেনমার্ক জনসংখ্যা মাত্র ৫৬ লক্ষ । পদক ২ টি সােনা , ৬ টি রূপাে , ৭ টি ব্রোঞ্জ , মােট ১৫ টি । আর দেশের নাম বাড়িয়ে লাভ নেই । ১২৫ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতবর্ষ এবার অলিম্পিকে পেয়েছে মাত্র ১ টি রূপাে ও ১ টি ব্রোঞ্জ পদক । পি . ভি . সিন্ধু ও সাক্ষী মালিক । তাদেরকে নিয়ে অবশ্য আমরা মাতামাতি কম করিনি ! কিন্তু এই লজ্জার হাত থেকে পরিত্রাণের কি কোন উপায় নেই ? এর কি কোন প্রতিকার নেই ? আমি মনে করি আছে । অলিম্পিকে ভারতের মান উন্নত করার উপায় আছে । কিভাবে করা যাবে ? এজন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে কিছু দায়িত্ব পালন করতে হবে । কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে । কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণেরও কিছু দায়িত্ব , কর্তব্য আছে । জনসাধারণের কর্তব্য হচ্ছে , তাদের ক্রিকেটাসক্তি কম করা । আমার ছােটবেলায় ক্রিকেটে ওয়ান ডে , টি -২০ , ইত্যাদি ছিলনা । তখন পাঁচদিনের টেস্ট ম্যাচ হত । আমিও জয়সীমা , কুন্দেরন , ফারুক ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতি খেলােয়াড়ের ভক্ত ছিলাম । কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা প্রশ্ন সেই ছােটবেলাতেই মনে আসত । পাঁচদিন সারাদিন ধরে যা অনুষ্ঠিত হয় , তা খেলা কি করে হয় ? খেলা তাে কাজের ফাঁকে একটু আনন্দের জন্য । অর্থাৎ এত দীর্ঘ সময় ধরে যা হয় , তা আর যাই হােক খেলা হতে পারে না । জনসাধারণের এটা বােঝা দরকার আছে যে ভারতে ক্রিকেট আর খেলা নয় । ওটা হচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানীর বিঞ্জাপনের একটা মাধ্যম মাত্র । বিভিন্ন কোম্পানি তাদের জিনিস বিক্রির জন্য ক্রিকেটের পিছনে টাকা ঢেলে তাকে জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয় করে তােলে । মানুষের এটা মনে রাখা দরকাব , সারা বিশ্বে ইংলন্ড ও অস্ট্রেলিয়া ছাড়া আর কোন উন্নত দেশ ক্রিকেট খেলে না । যে দেশগুলাে ক্রিকেট খেলে তারা প্রায় সবাই আগে ইংলন্ডের কাছে পরাধীন দেশ ছিল । অস্ট্রেলিয়াও । অর্থাৎ ক্রিকেট হচ্ছে । পরাধীনতার প্রতীক । মানসিক দাসত্বের চিহ্ন । আমাদের কাছে গ্যারি সােবার্স বা ব্রাডম্যান যতই লিজেন্ডারি ব্যক্তিত্ব হােন না কেন , আমেরিকা , রাশিয়া , চীন , জাপান , ফ্রান্স , জার্মানীর কোন শিক্ষিত ব্যক্তিও ওই দুজনের নামই শােনেনি কোনদিন । সাধারণ শিক্ষিত সম্পন্ন ভারতবাসী যখন ক্রিকেটকে গুরুত্ব কম দেবে , কেবলমাত্র তখনই অন্য খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়বে । সেই খেলাগুলাে গুরুত্ব পাবে । উন্নতি হবে । কিন্তু আসল দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকে । খেলার উন্নতিতে সরকারের প্রধান কাজ কী ? প্রধান কাজ দুটি । প্রথম , খেলাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে । ক্রীড়াক্ষেত্রে যেখানে সরকারের একটা টাকাও ব্যয় হবে , সেখানে একজনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যেন না থাকে । উদাহরণ – একসময় ইন্ডিয়ান ফুটবল এসােশিয়েশনের সভাপতি ছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী । তাঁর নিজের কথায় , তিনি কখনাে ফুটবল খেলেন নি । অনুরূপভাবে ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসােশিয়েশন , এশিয়ান গেমস্ , বিভিন্ন স্পাের্টস বডিতে অনেক রাজনৈতিক নেতারা বসে আছেন । তাঁরা সবসময় স্বজনপােষণ ও দুর্নীতি করেন । তাঁদের অধীনে কখনাে মেধা ও প্রতিভা স্বীকৃতি পায় না । পায় ভাই-ভাতিজারা । এর সবথেকে বড় উদাহরণঃ- বিগত ডঃ মনমােহন সিং – এর সরকারে ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন সুরেশ কালমাদি । তিনি যে ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসােশিয়েশন তৈরী করে দিয়েছিলেন , ২০১৪ – তে মােদী সরকার এসে তা পরিবর্তন করেন নি । করলেই তাে হিন্দুবিরােধী মিডিয়ারা শেয়ালের মত হুক্কা হুয়া রব তুলে দিত – মােদী প্রতিহিংসাপরায়ণ । তাই আগের সরকারের নিযুক্ত সবাইকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজের লােক ভরে দিচ্ছে । তাই এবার রিও অলিম্পিকে ভারত থেকে অংশগ্রহণকারী খেলােয়াড়দের সঙ্গে সাহায্য করার জন্য ৬৪ জন অফিসিয়াল সেখানে গিয়েছিলেন । যখন মহিলা ম্যারাথন দৌড় হচ্ছিল , ভারতের রানার ও . পি . জইশাকে একটা জলের বােতল দেওয়ার জন্য একজনও অফিসিয়াল সেখানে উপস্থিত ছিলেন না । তারা সব মার্কেটে , মলে আর সী-বীচে ফুর্তিতে ব্যস্ত ছিলেন । একফোঁটা জল না পেয়ে ৪২ কিমি . দৌড়ানাের পর জইশা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান । অলিম্পিক কর্তৃপক্ষ তাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যান । তিনঘন্টা পর তার জ্ঞান ফিরে আসে । এই ৬৪ জন দায়িত্বজ্ঞান ফুর্তিবাজ অফিসিয়ালকে কে বা কারা মনােনীত করেছিল ? মনমােহন সিংয়ের ক্রীড়ামন্ত্রী সুরেশ কালমাদি ও তার নিযুক্ত ভারতের বিভিন্ন ক্রীড়াসংস্থা । এরমধ্যে অন্যতম এথেলেটিক ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া ( A. F. I ) । এই সংস্থার সেক্রেটারি সি . কে . ভালসন । রিও থেকে ফিরে এসে জইশা যখন তার অভিজ্ঞতা এখানে সকলকে জানালেন , সি.সি.ক্যামেরাতে তােলা ভিডিও তে সেকথা প্রমাণিত হল , তারপরও এই সি . কে . ভালসন নির্লজ্জের মত জইশাকেই দোষারােপ করছিলেন । এতখানি ঔদ্ধত্য তার । এই ঘটনাটা তাে প্রকাশ্যে এল । কিন্তু সব ঘটনা প্রকাশ্যে আসে না । ভারতের ক্রীড়াক্ষেত্রে খেলােয়াড়দের কোন গুরুত্বই নেই । তা হচ্ছে সরকারী রাজনৈতিক দলের নেতা মন্ত্রীদের ও তাদের আত্মীয়-চাপলুসজের ফুর্তিকরার জায়গা । এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে প্রতি অলিম্পিকে আমাদেরকে এই লজ্জার সম্মুখীন হতে হবে । এর থেকে অনেক ভাল অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধি না পাঠানাে । সরকারের দ্বিতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণকরণীয় কাজ আছে । তা হচ্ছে , খেলােয়াড় , অ্যাথলেটিক , সাঁতারু , তীরন্দাজ ইত্যাদি সিলেকশন ও প্রশিক্ষণের জন্য শহরের বদলে গ্রামকে গুরুত্ব দেওয়া । কলকাতার কলেজ স্কোয়ার , হেদুয়া অথবা বালিগঞ্জের রবীন্দ্র সরােবরে গিয়ে যেন প্রতিভাবান সম্ভাবনাময় সাঁতারু খোঁজা না হয় । সাঁতারু চয়ন করতে পুরী , রামেশ্বর বা কালিকটের সমুদ্রতীরে যেন খোঁজা হয় । ভারতে প্রায় ৩০০০ কিমি . সমুদ্রতীর আছে । আন্দামান ধরলে আরও অনেক বেশি । সমুদ্রপাড়ের ছেলে মেয়েরা , বিশেষ করে জেলেদের ছেলে মেয়েরা এমনিতেই সমুদ্রে সাঁতার কাটে । তাদের দমও অনেক বেশি হয় । সেখানে সাঁতারুর সন্ধান না করার কোন ক্ষমা নেই । একই কথা প্রযােজ্য অ্যাথলেটিকস্ – এর সমস্ত বিভাগে । আমি নিজে দেখেছি গােপীবল্লভপুরে জঙ্গলে ৭-৮ বছরের শিশুকে খরগােসের পিছনে তীব্র বেগে ছুটতে । শহরের বাচ্চা তা কল্পনাও করতে পারবে না । তীরন্দাজ বস্তারের বা ঝাড়খন্ডের জঙ্গলে না খুঁজে বম্বে শহরে খুঁজলে কোনদিনই আমরা অলিম্পিকে সাফল্য পাব না । সুতরাং সরকারের এই দুটি কাজ । ক্রীড়াদপ্তরকে করতে হবে সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত ও খেলােয়াড় যুক্ত । আর খেলােয়াড় খোঁজা ও প্রশিক্ষণের জন্য শহর বাদ দিয়ে গ্রামে নজর দিতে হবে । এই দুটি কাজ ঠিকমত করলেই আমরা অলিম্পিক লজ্জার হাত থেকে মুক্তি পাব ।সংকলন শুভঙ্কর নাগ সংগৃহীত স্বদেশ সংহতি সংবাদ সেপ্টেম্বর ২০১৬ #suparhumanTAPANGHOSH
